ব্যুরো চিফ-
টাঙ্গাইলে পরিবহন চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে জেলা বাস কোচ মিনি বাস মালিক সমিতির বিরুদ্ধে। ১০০ টাকার আমানত কুপন ছাপিয়ে বছরে চাঁদা তুলেছে প্রায় দুই কোটি টাকা। বছর শেষে এই টাকা মালিকদের ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয় না। আবার বছরে একদিন পিকনিকের নামে আনন্দ ভ্রমণ তহবিল কুপন ছাপিয়ে সারা বছর প্রতি বাস থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এই তহবিলে বছরে আদায় হচ্ছে প্রায় কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বছরে মোট চাঁদা উঠে প্রায় ৭-৮ কোটি টাকার মতো। এই টাকা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলসহ বিভিন্ন খাতে ভাগবাটোয়ারা হয়।
গত বছর আনন্দ ভ্রমণের নামে বহিরাগতদের বিমানে করে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হয়। এমনকি তাদেরকে পাঁচতারকা হোটেলে সিট দেয়া হয়। আর মালিকদেরকে লক্করঝক্কর বাসে করে নেয়া হয়। তাদেরকে নিম্নমানের খাবার দেয়া হয়। এমন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মালিকরা।
অভিযোগ রয়েছে, জেলা মালিক সমিতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসাবে চাঁদার টাকার একটি বড় অংশ লুটপাট করছেন শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা বাস কোচ মিনি বাস মালিক সমিতির মহাসচিব গোলাম কিবরিয়া বড় মনি। তার দাপটে মালিকরা ছিলেন অসহায়। তারা মুখ বন্ধ করে সব সহ্য করে গেছেন। কিন্তু গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। এরপর থেকে গোলাম কিবরিয়া বড় মনি আত্মগোপনে চলে যান।
বড় মনি আত্মগোপনে যাওয়ার পর তার কর্মকাণ্ড নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগী মালিকরা। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক সমিতির সকল নেতৃবৃন্দকে ডেকে মৌখিকভাবে বলেছিলেন এই কমিটির মেয়াদ হবে এক বছর। কিন্তু এক বছর পর নির্বাচন দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করতে হবে। অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে বাস কোচ মিনি বাস মালিক সমিতি চলছে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া; অবৈধভাবে এখনো টিকে আছে মালিক সমিতির বর্তমান কেবিনেট। বড় মনির সহযোগী হিসেবে মালিক সমিতির বর্তমান সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন, মিনি বাস বিভাগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম তুষার ও বাস বিভাগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ পাল এখনো তাদের দায়িত্ব পালন করছেন।
জানা যায়, ২০১২ সালে তৎকালীন বাস বিভাগের সভাপতি কামরুজ্জামান খান ও সাধারণ সম্পাদক ‘খান পরিবারের সন্তান’ জাহিদুর রহমান খান কাকন ও নজরুল ইসলাম মিটনরা দখলদারিত্ব শুরু করেন। এর পূর্বে বাস ও মিনি বাস আলাদা সমিতি হিসেবে ছিল। কিন্তু ২০১২ সালের শেষের দিকে বাস ও মিনি বাসকে একত্রিত করে কাকন মহাসচিব, কামরুজ্জামান খান সভাপতি ও নজরুল ইসলাম মিটন সাধারণ সম্পাদক (মিনিবাস), রাশেদুর রহমান তাবীব সাধারণ সম্পাদক বাস বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। নজরুল ইসলাম মিটন বিএনপি নেতা পরিচয় দিলেও তিনি কাকনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ২০১৪ সালে বিএনপি যখন অবরোধের ডাক দেয় তখন টাঙ্গাইলের প্রায় সকল বাস বন্ধ থাকলেও নজরুল ইসলাম মিটনের বাস এবং কতিপয় মালিকদের বাস অবরোধ ভঙ্গ করে পরিচালনা করেন। যা নিয়ে বিএনপি নেতা কর্মীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এখানে আরও উল্লেখ থাকে যে, অবরোধের সময় যে সকল পরিবহনে অগ্নিসংযোগ করা হয় সে সকল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন মালিকদেরকে সরকার ক্ষতিপূরণ দেয়। সেই ক্ষতিপূরণের বেশির ভাগ টাকা নজরুল ইসলাম মিটন একাই আত্মসাৎ করেন। কাকনের অনুপস্থিতে পরিবহনের সকল চাঁদাবাজির টাকা মিটনের কাছে গচ্ছিত থাকতো। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলায় জাহিদুর রহমান খান কাকনসহ তার অপর তিন ভাইয়ের নাম উঠে আসে। এরপর অভিযুক্তরা আত্মগোপনে চলে যান। তখন কাকন ও মিটনসহ তাদের অনুসারীরাও আত্মগোপনে চলে যান। এরপর টাঙ্গাইলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়। ওই সময় টাঙ্গাইলে ফাঁকা মাঠে উত্থান ঘটে জার্মান ফেরত দুই সহোদর তানভীর হাসান ছোট মনির ও গোলাম কিবরিয়া বড় মনির। ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে নতুন কমিটি দলের কেন্দ্র থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই কমিটিতে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদকের পদ পান তানভীর হাসান ছোট মনির। ২০১৫ সালে বাস কোচ মিনি বাস মালিক সমিতির মহাসচিব পদ দখল করে নেন বড় মনি। তারপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছোট মনির টাঙ্গাইলের-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর থেকে জেলার প্রায় সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে থাকে। পরবর্তীতে বড় মনি মহাসচিব ও খন্দকার ইকবাল হোসেন সভাপতি হিসেবে সমিতি দখলে নিয়ে নেন। অদ্যাবধি পর্যন্ত বড় মনিরের অনুসারীরা সমিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন।
পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানান, টাঙ্গাইলে যে পরিবার যখন দাপটে থাকেন সেই পরিবারের সদস্যরা জেলা বাস মালিক সমিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। অবৈধ আয়ের সোনার খনি হিসেবে পরিচিত এই খাতের ওপর দৃষ্টি পড়েছে সবার। নানা কারণে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর উত্থান ঘটে অন্য পরিবারের। এভাবেই চলে আসছে।
সাধারণ মালিকরা জানান, মহাসচিব পদ একটি রাজনৈতিক পদ। এ পদ সৃষ্টি হয়েছে লুটপাটরে জন্য। মহাসচিব পদ বিলুপ্তের জোর দাবি জানান অনেক সাধারণ মালিকরা। তারা আরও জানান, পূর্বের ন্যায় দুই সমিতি পৃথক ভাবে থাকলে ব্যবসায় প্রতিযোগিতা হবে। চাঁদাবাজিও কমে যাবে। তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মালিক সমিতির নেতৃত্ব দেখতে চান।
মালিক সমিতির একাধিক নেতা ও মালিকরা জানান, টাঙ্গাইল জেলা বাস কোচ মিনিবাস মালিক সমিতিভুক্ত গাড়ির সংখ্যা ৮’শর মতো। এর মধ্যে গড়ে প্রতিদিন অন্তত ৪৫০ বাস চলাচল করে। প্রতিদিন একটি বাস থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এ হিসাবে প্রতি মাসে চাঁদা ওঠে ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বছরে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ কোটি ১ লাখ টাকা। এই টাকা সমিতির পরিচালনা ব্যয়, মালিকের আমানত, আনন্দভ্রমণ তহবিল, কাউন্টার মাস্টার ও লাইনম্যানসহ বিভিন্ন খাতে ভাগবাটোয়ারা হয়। টাঙ্গাইল পরিবহন সমিতির উপজেলা পর্যায়ে শাখা অফিস দেওয়া হয়েছে। সেখানকার চাঁদার টাকার ভাগও আসে বড় মনি’র কাছে। এছাড়া এলেঙ্গা স্পটে উত্তরাঞ্চলে চলাচলকারী প্রতিটি গাড়ি থেকে ১০০-১৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মালিক বলেন, কাকন, কামরুজ্জামান খান, তাবীব ও মিটনদের সময় থেকে লুটপাট শুরু হয় পরিবহন খাতে। এরপর বড় মনি, ইকবাল ও তুষাররা পরিবহন সেক্টরকে ধ্বংস করেছে ফেলেছে। চাঁদাবাজি করায় হচ্ছে তাদের মূল কাজ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মালিক সমিতির সাবেক নির্বাচিত এক কর্মকর্তা বলেন, আমি দীর্ঘদিন যাবত পরিবহন ব্যবসার সাথে জড়িত। ১৭ বছর যাবত দলীয় ব্যানারে মালিক সমিতি চাঁদাবাজি এবং লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। টাঙ্গাইল বাস মিনি বাস মালিক সমিতি আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মালিক সমিতির নেতারা মালিক কল্যাণে কোন কাজ করেনি।
এদিকে টাঙ্গাইল জেলা বাস কোচ মিনি বাস মালিক সমিতির মহাসচিব গোলাম কিবরিয়া বড় মনি আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় ও তার মুঠোফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
টাঙ্গাইল জেলা বাস কোচ মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন বলেন, আমানত ও আনন্দ ভ্রমণের কুপনের টাকা লুটপাটের ঘটনার বিষয়টি ঠিক নয়। এক বছর পর টাকা ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু গত বছর টাকা ফেরত দেওয়ার সময়ে পিকনিক হওয়ায় ওই খাতের টাকা পিকনিকে খরচ করা হয়েছে। বর্তমানে আমরা চাঁদা বন্ধ করে দিয়েছি। সব ফান্ডের টাকা একত্রিত করে মালিকদের নিজস্ব টাকা ফেরত দেয়া হবে। আগামী অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের মধ্যে এই টাকা ফেরত দেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন উপজেলা থেকে যে চাঁদা তোলা হতো সেগুলো বড় মনির পকেটে যেত। তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কাজে ব্যবহৃত হতো। সে থাকাকালীন সময়ে আমরা কোন মালিকরা শান্তিতে ছিলাম না। বড় মনি দলীয় ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একচ্ছত্র ভাবে সমিতি পরিচালনা করেছেন। এজন্য নির্বাচন দেয়া সম্ভব হয়নি। আমিও চাই নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হোক।