মোঃ সাইফ উদ্দিন রনী, কুমিল্লা ব্যুরো প্রধান:
আনভীরের একটি পছন্দের গান, যা তিনি কোন একদিন আমাকে পাঠিয়েছিল, আজকে তাকে পাঠিয়ে বললাম “ আমি এখনও এটি শুনি কারন আমি এখনও আপনাকে ভালবাসি (ডায়েরীর পাতা ১৮.০২.২০২০)। আজকে আনভীরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। জানিনা তবে সারাদিন তাকে নিয়ে ভাবি হয়তো তাই। এবং এটাই আমি তাকে জানাই, তিনি বললেন আমাকে, তুমি আমার ভাল চাও তাই দেখ হয়তো (ডায়েরীর পাতা ১৭.০৯.২০২০)। বসে আমি আর আনভীরের কথা ভাবছি। তার তো অনেক কিছুই আছে জীবনে, তবে আমার জীবন এখনও সেই ব্যস্ততায় যায় নাই। আল্লাহ যা কিছু করবে আমার উত্তম। অপেক্ষায় আছি কবে তিনি দেখা করার কথা বলছেন, মিস ইউ আনভীর। (ডায়েরীর পাতা ৩০.০৯.২০২০)। আনভীরকে নিয়ে এমন অনেক ভালবাসা ও মান অভিমানের কথা লেখা আছে মুনিয়ার ডায়েরীতে যার গুলশান থানা পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। প্রেমের পর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মোসরাত জাহান মুনিয়াকে গুলশানে একটি ফ্লাটে বাসা করে রেখেছিলো বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর। মুনিয়া বিয়ের জন্য চাপ দিলে পরে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়, এমন অভিযোগ মোসরাত জাহান মুনিয়ার পরিবারের। মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান এমনই অভিযোগে করে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-২৭ (তাং ২৭.০৪.২০২১)।
নিহত মুনিয়ার বাড়ি কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর উজির দীঘির দক্ষিনপাড় ১৫২/১৪৩ ক “সেতারা সদন” নামক বাসা । কুমিল্লা মর্ডান প্রাইমারি স্কুল ও হাই স্কুলে থেকে ৯ম শ্রেনী পযর্ন্ত লেখাপড়া করে ঢাকা মিরপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে লেখাপড়া করত। সে এবার এইচএসসি পরিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান ও মা সেতারা বেগম ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। মা বাবা কেউই বেঁচে নেই। ২ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মুনিয়া ছিল সবার ছোট। মুনিয়ার বড় ভাই আশিকুর রহমান সবুজ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সাধারধ সম্পাদক ও একজন ঠিকাদার, বোন নুসরাত জাহান একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আছেন।
এদিকে গুলশান থানায় মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহানের দায়ের করা মামলা থেকে জানা যায়, মুনিয়া মিরপুর ক্যান্টমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের এইচএসসি পরিক্ষার্থী ছিল। গত দুই বছর আগে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহম্মেদ আকবর সোবহানের ছেলে এ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের সাথে পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর বিভিন্ন স্থানে দেখা স্বাক্ষাত ও মোবাইল ফোনে কথাবার্তা হতো এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে মুনিয়াকে আনভীর স্ত্রী পরিচয়ে বনানীতে একটি ফ্লাটে বসবাস শুরু করে। ২০২০ সালের ফেব্রয়ারীতে তাদের সম্পর্ক জানতে পেরে সায়েম সোবহান আনভীরের মা তাদের বাসায় ডেকে নিয়ে হুমকি দামকি ও ভয়ভীতি দেখায় এবং ঢাকা থেকে চলে যেতে বলেন। পরে আনভীর কৌশলে পরবর্ত্তীতে বিয়ে করবে বলে আশ^স্ত করে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেয়। পরবত্তীর্তে এ বছরের মার্চের ১ তারিখে মুনিয়াকে প্ররোচিত করে কুমিল্লা থেকে ফুসলিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে এবং গুলশান ১ নম্বর এভিনিউয়ের ১২০ নম্বার সড়কের ১৯ নম্বর প্লটের বি/৩ ফ্ল্যাটটি ১ লক্ষ টাকায় মাসিক ভাড়া নেয়। বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত ও তার স্বামী মিজানুর রহমানের আইডি কার্ড ব্যবহার করা হয়। বাসাটির একটি কক্ষে ভানভীর ও মুনিয়ার স্বামী স্ত্রীর মতো করে একটি ছবি বাধিয়ে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখে। সে কক্ষটি সবসময় পরিপাটি থাকত আনভীর যখন আসতো তখন রুমটিতে থাকতো।আনভীর মুনিয়াকে বিয়ে করে দেশের বাহিরে সেটেল করে রাখবে বলে জানায়। দেশে থাকলে জানাজানি হলে মুনিয়াকে মেরে ফেলতে পারে আনভীরের মা বাবা। এ বছরের মার্চের ১ তারিখ থেকেই মুনিয়াকে এ ফø্যটে রেখে আনভীর নিয়মিত আসা যাওয়া করতো। স্বামী স্ত্রীর মত বসবাস করতো। গত শুক্রবার মুনিয়া বড় বোন নুসরাতকে ফোন করে জানায়, আনভীর তাকে অনেক বকাবকি করেছে। কারন বাসার মালিকে বাসায় গিয়ে মুনিয়া ইফতার করেছে, ওই বাসার মালিকের স্ত্রী তা ফেইসবুকে পোষ্ট করেছে। আর আনভীরের এক ঘনিষ্টজন ওই ফ্লাট মালিকের স্ত্রীর ফেইসবুক ফেন্ড। ওই ছবি দেখে আনভীরের মাকে জানাবে এ নিয়ে আবার জামেলা তৈরী হবে। তখন আনভীর ২৭ এপ্রিল দুবাই চলে যাচ্ছে বলে মুনিয়াকে কুমিল্লায় চলে যেতে বলে। কারন আনভীরের মা জানতে পারলে তাদের মেরে ফেলবে। পরে মুনিয়া ২৫ এপ্রিল সকালে তার মোবাইল থেকে বড় বোন নুসরাতকে কল করে কান্নাকাটি করে বলে আনভীর তাকে বিয়ে করবে না। তাকে শুধুমাত্র ভোগ করে গেছে। তুই আমার শত্রর সাথে হাত মিলিয়েছস, মনে রাখিস আমি তোকে ছাড়ব না। মুনিয়া তার বোনকে তাড়াতাড়ি কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসতে বলে, নয়তো আনভীর যে কোন সময় তার বড় ক্ষতি করতে পারে। নুসরাত তখন তার মামাতো বোন ইভা ও ফুফাত ভাই ইকবালকে নিয়ে ২৬ এপ্রিল ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেন। ঢাকার যাওয়ার পথে মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত একাধিকবার তার নাম্বার কল দিলেও ফোন গ্রহন হয়নি। পরে এ দিনেই সোয়া ৪টার দিকে গুলসান বাসায় গিয়ে দরজা নক দিয়ে কোন সাড়া শব্দ না পাওয়ায় বাসার মালিকের সহযোগিতায় মিস্ত্রি এনে দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করি মুনিয়ার দেহ গলায় ওড়না দিয়ে পেচানো অবস্থায় সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলানো দেখা যায়। পরে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ আসলে তাদের নিয়ে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তখন ফ্যানের সাথে ঝুলানো অবস্থায় থাকলেও মুনিয়ার দু’পা খাটের সাথে লেগে ছিলো ও বাকা ছিলো। পুলিশ তখন মরদেহের সাথে তার ব্যবহত ২ টি মোবাইল, ডায়েরী ও দেওয়ালে ঝুলানো ছবি ও অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
এ ব্যাপারে মামলার বাদী মুনিয়ার রড় বোন নুসরাত জাহান জানান, বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের সাথে আমার বোনের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। আমার বোনকে বিয়ে করবে বলে ফুসলিয়ে মার্চে ঢাকা নিয়ে আসে। স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে গুলশানের একটি বাসায় রাখে। আমার বোন তাকে বিয়ের জন্য সবসময় বলত। কয়েকদিন আগে আমার বোনের সাথে এ নিয়ে ঝগড়া হয়। তখন তাকে মেরে ফেরার হুমকি দেয়। আনভীর আমার বোনকে মেরে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখে। এ ঘটনায় আমি থানায় মামলা দায়ের করি।
নিহত মুনিয়ার বড় ভাই আশিকুর রহমান সবুজ বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর পরিকল্পিতভাবে আমার বোনকে হত্যা করেছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চাই। তিনি বলেন আমাদের সবার ছোট আদরের বোনটির এমন অকাল মৃত্য আমরা মেনে নিতে পারছিনা। নগরীর টমছমব্রীজে আমাদেও মা ও বাবর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে।