সাকিব আসলাম
সাভারের সাবেক সংসদ সদস্য ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সামছুদ্দোহা খান মজলিসের স্ত্রী আলোচিত সেলিমা খান মজলিস হত্যা মামলার রহস্য পুরোপুরি উদঘাটনের দ্বারপ্রান্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
খুনের ঘটনার দীর্ঘ ১৩ বছর পর ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ৫ জনকে আটকের পর কয়েক দফা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সংস্থাটি। এদের মধ্য থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, নিহত সেলিমা খান মজলিসের বড় মেয়ে শামীমা খান মজলিস পপি(৫৫), প্রতিবেশী ও ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায়(৫০) ও গৃহ-পরিচারিকা সরস্বতী সরকার (৪০)।
গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. কুদরত-ই-খুদা।
পিবিআই সূত্র জানায়, সেলিমা খান মজলিস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সুবল কুমার রায়ের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হলে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় ঘটনার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় সুবল কুমার রায়।
সূত্র আরো জানায়, সুবল কুমার রায়ের স্বীকারোক্তির পর নিহত সেলিমা খান মজলিসের বড় মেয়ে শামীমা খান মজলিস পপি ও গৃহ-পরিচারিকা সরস্বতী সরকারকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাদের দুজনকে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বর্তমানে তারা পিবিআই হেফাজতে রয়েছে।
২০১১ সালের ১৪ই জুন সাভার মডেল থানা সংলগ্ন দক্ষিণপাড়ায় নিজ বাসভবনে দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হন সেলিমা খান মজলিস। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ই জুন রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মারা যান তিনি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ঘটনার পরপরই আমাদের ধারণা হয়েছিল রাজধানীর উত্তরায় থাকা সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে মা সেলিমা খান মজলিস ও মেয়েদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ও বিরোধ সৃষ্টির কারণে অথবা বড় মেয়ের পরকীয়া প্রেমে বাধা দেওয়ার কারণে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
২০১১ সালে এই ঘটনার তদন্তে ঘটনাস্থল ও আশেপাশের এলাকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল। ওই দলের তৎকালীন প্রধান পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, আঙ্গুলের ছাপ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত দলের সদস্যরা ওই বাড়ির রক্তমাখা বিছানা,দরজার কাছে পাওয়া হাতের ছাপসহ পরিবারের সদস্যদের আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করার পাশাপাশি বেশ কিছু আলোচিত্র সংগ্রহ করেছে।
১৪ই জুন(২০১১)মঙ্গলবার সকালে নিজ বাড়ির দোতলার একটি কক্ষে অর্ধেক গলাকাটা অবস্থায় রক্তাক্ত সেলিমা খান মজলিসকে উদ্ধার করে নেয়া হয় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পেটে উপর্যুপুরি ও গলায় ধারালো ছুরি চালিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করে দুর্বত্তরা। সেখানে দীর্ঘসময় ধরে অস্ত্রপচার করা হয় তাঁর দেহে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এলে তিনি সেলিমা খান মজলিসের চিকিৎসার সকল দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দেন। ওইদিন বিকেলেই তাকে সাভার থেকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। ঘটনার পর থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা একটি ছোরাসহ জব্দ করে কিছু আলামত। পরদিন ১৫ই জুন(২০১১) বুধবার বিকেলে এ ঘটনায় অজ্ঞাত আসামীদের বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টা মামলা দায়ের করা হয় সাভার মডেল থানায়। মামলার বাদী হন সেলিমা খান মজলিসের ছোটভাই সাফিউর রহমান খান।
১৮ই জুন (২০১১) সেলিমা খান মজলিস চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর সাভার মডেল থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুবুর রহমান আলোচিত এই হত্যা প্রচেষ্টার মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে গ্রহণ করেন।
এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে পুলিশ আটক করে সেলিমা খান মজলিসের নাতনি তিলোত্তমা খান মজলিসের স্বামী আবুল কালাম আজাদ (৩২), তার খালাতো ভাই সেলিম (২৬), গৃহ-পরিচারিকা সরস্বতী সরকার (৩২) ও তার স্বামী হরিপদ সরকার (৪০)কে। এদের মধ্যে সে সময় আবুল কালাম আজাদ ও হরিপদ সরকারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করে আদালতে প্রেরণ করে। আদালত দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেও ঘটনার কারণ উৎঘাটন করতে পারেনি তৎকালীন তদন্তকারীরা।
তবে তৎকালীন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক শেখ ফরিদ আহমেদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তদন্ত চলছে। রিমান্ডে আনা দুজনকে দুই দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। তিনি বলেছিলেন, ওই বাড়ির বাসিন্দাদের কল লিষ্টও পরীক্ষা করা হচ্ছে। বাইরে থেকে দুর্বৃত্তরা ওই বাসায় ঢুকেছে এখন পর্যন্ত এমন কোন আলামত ও পাওয়া যায়নি। প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে,এ হত্যাকান্ডের সাথে নিহতের স্বজনরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। কিছু দিনের মধ্যেই এ মামলার সকল জট খোলা সম্ভব বলেও জানান তিনি।
তবে বিষয়টি নানা তদন্ত সংস্থার হাত বদল হলেও শেষ পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের কোনো জট আর খোলেনি।
দীর্ঘ চার বছর তদন্ত শেষে ২০১৫ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) হত্যাকাণ্ডে কারও সম্পৃক্ততা না পেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। এতে পরিবারের কেউ নারাজির আবেদন ও করেননি। তাই আদালত মামলার সব নথি সাভার মডেল থানায় পাঠিয়ে দিয়ে তা ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেয়।
হত্যার বহুদিন কেটে গেলেও অবশেষে ১৩ বছর পর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে প্রাথমিকভাবে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআই এর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন নিহতের স্বজনরা ও সাভার বাসী। তারা এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার জন্য দাবি জানিয়েছেন।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সাভারে আওয়ামী রাজনীতিতে কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এক সময়ের প্রভাবশালী এই পরিবারটি দীর্ঘদিন ছিলো আলোচনার বাইরে। ২০১১ সালের আগে থেকে দুই মেয়ে শামীমা খান মজলিস পপি, সেলিনা খান মজলিস শিল্পী ও এক প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়েই নিহত সেলিমা খান মজলিস থাকতেন দোতলা বাড়িটিতে। অন্য মেয়ে ইলোরা খান মজলিস ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। প্রতিদিনের মতো ওই দিন ভোরে সেলিমা খান মজলিসের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছোট মেয়ে ইলোরা মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ফোন করেও কোন উত্তর না পেয়ে তিনি ফোন করেন নিচতলায় থাকা বড় বোন শামীমা খান মজলিস পপিকে। জানান, দীর্ঘ সময় ধরে রিং বাজলেও মা ফোন ধরছেন না। পপি পাশের ফ্লাটে থাকা আরেক বোন সেলিনা খান মজলিস শিল্পীকে সাথে নিয়ে ছুটে যান দোতলায়। সেখানে দেখা যায় খাবার ঘরের মেঝেতে রক্ত। পাশে আরেকটি কক্ষের খাটের ওপর অর্ধেক গলাকাটা অবস্থায় রক্তাক্ত মাকে পড়ে থাকতে দেখে তারা চিৎকার দেন। পরে এলাকাবাসী ছুটে গিয়ে গুরুতর আহত সেলিমা খান মজলিসকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
বা বু ম/ অভিজিৎ রায়