সোহেল রানা
চাঁদার দাবিতে সাভার পৌরসভার সেই বিতর্কিত নারী কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তার ঘনিষ্ঠ অনুসারী কিশোর গ্যাং নাজিম বাহিনীর দ্বারা একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে অতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটেছে।
হামলাকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট অন্তত ৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ছুরিকাঘাতে নাহিয়ান (২৫) নামে এক ব্যবসায়ীর ফুসফুস ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বরত চিকিৎসকরা।
তাকে মুমূর্ষ অবস্থায় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও অবস্থার অবনতি হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে প্রেরণ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) রাত ৮ টার দিকে প্রথমে ছায়াবীথি আমতলায় অফিস ভাঙচুর ও লুটপাট এবং দ্বিতীয় দফায় রাত প্রায় এগারটার দিকে সাভার পৌরসভার ছায়াবীথি সোসাইটি রোডে এই হামলার ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী আকাশ বাদী হয়ে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলায় আসামিরা হলেন, নারী কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তার অনুসারী কিশোর গ্যাং গ্রুপের প্রধান ও গণি মিয়ার ছেলে নাজিম ওরফে ভাইগ্না নাজিম (২৮) , ছায়াবীথি সোসাইটি এলাকার মিলন মিয়ার ছেলে আশরাফুল (২২), নূরু ব্যাপারীর ছেলে ওয়াসিম (২৭), রহমান কসাইয়ের ছেলে শান্ত (২৬), মোহাম্মদ আকাশের ছেলে অপু (২৩), রহমান কসাইয়ের ছেলে পাপ্পু (২৪) ও সবুজবাগ এলাকার আরমানের ছেলে লাদেন ওরফে কুপা লাদেন (২৪)। এছাড়াও অজ্ঞাত নামা আরো ১২ জনকে আসামী করা হয়েছে।
তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে এ ঘটনায় অভিযুক্ত আশরাফুল ও লাদেন ওরফে কুপা লাদেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সাভার মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) নয়ন কারকুন।
এজাহার ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত কয়েকদিন যাবত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক দ্বীন ইসলামের কাছে চাঁদা দাবি করে আসছিল নাজিমসহ তার গ্যাংয়ের সদস্যরা। ঘটনার দিন রাত ৮ টায় ছায়াবীথি আমতলা এলাকায় অফিসে চাঁদা নিতে আসেন অভিযুক্তরা। ঠিকাদার দ্বীন ইসলামকে না পেয়ে তার কর্মচারী আকাশকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ সহ অতর্কিতভাবে পুরো অফিস ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় তারা। এতে বাধা দিলে আকাশকে মারধর করে একটি সেমসাং ব্র্যান্ডের মোবাইল ও একটি ল্যাপটপ নিয়ে চলে যায় অভিযুক্তরা।
এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তার কাছে বিচার চায় ভুক্তভোগীরা। তবে কিশোর গ্যাং প্রধান নাজিম এখন মদ্যপ অবস্থায় আছেন এমন কথা বলে পরের দিন বসতে বলেন তিনি। তা মেনে নিয়ে অফিস বন্ধ করে বাড়িতে যাওয়ার পথে রাত ১১ টায় ছায়াবীথি সোসাইটি রোডে দ্বিতীয় দফায় আকাশকে পেয়ে তার ওপর হামলা চালায় গ্যাং প্রধান নাজিমসহ তার বাহিনীর সদস্যরা। এসময় তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসলে কিশোর গ্যাংয়ের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আকাশের মামা মামুন ও ব্যাবসায়ী নাহিয়ান ঘটনাস্থলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ সময় সংঘর্ষে আহত হয় আরো তিনজন। হামলার পরই দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে দুইজনকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং তিনজনকে সুপার মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করে। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্যাবসায়ী নাহিয়ানের অবস্থার অবনতি হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে চিকিৎসকরা।
এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) নয়ন কারকুন বলেন, রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জড়িত দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানায় একটি নিয়মিত মামলা দায়ের হয়েছে। বাকি আসামীদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এর আগে ২০২১ সালের ৮ ই জুন “নারী কাউন্সিলরের মাদকের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ৫ কিশোর গ্যাং” শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ হলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাভার পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই একাধিক কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। শুরুতে বিচ্ছিন্নভাবে এরা আড্ডা অথবা দল বেঁধে ছোটখাটো অপরাধ করলেও, পরে এদেরকে প্রকাশ্যে মদদ দিতে থাকে এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালীরা। আর এখন প্রতিটি ওয়ার্ডেই কিশোর গ্যাং তৈরি করে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে মাদক ও চাঁদাবাজির ব্যবসা। কেবল মাত্র ৩নং ওয়ার্ডেই রয়েছে ৫টি কিশোর গ্যাং। আর এদের নিয়ন্ত্রণ করছেন কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, সানজিদা শারমিন মুক্তা ৩নং ওয়ার্ডে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি গড়ে তুলেছেন বিশাল মাদকের সিন্ডিকেট। নাজিম ও হিন্দাম নামের দুটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে এসব সিন্ডিকেট। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো এলাকা।
অনেকে জানান, মূলত এদের সক্রিয় অবস্থানের কারণেই এলাকার কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। কাউন্সিলর মুক্তার নিয়ন্ত্রণে থাকা আরও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা হচ্ছে, শান্ত, মানিক, পাখি, গ্যাস মুন্না ও নয়ন বাহিনী। মূলত এদের মাধ্যমে ছায়াবীথি, সবুজবাগ, সোটাইটি, বনপুকুর, সোবহানবাগ ও বালুরমাঠ এলাকায় মাদকের সিন্ডিকেট পরিচালনা করা হচ্ছে।
ফোন কল করলেই মাদক পৌঁছে যাচ্ছে গ্রাহকের হাতে। ডিজিটাল এমন সেবা কার্যক্রম একার পক্ষে চালানো সম্ভব না, তাই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তা।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ৩নং ওয়ার্ডের এক ইট বালু ব্যবসায়ী। তিনি আরও জানান, এলাকায় বাড়ি করতে হলে ইট, বালু, সিমেন্টের কাজ দিতে হবে আর বাড়ি বিক্রি করতে দিতে হবে কমিশন, এমন অলিখিত নিয়ম চালু করেছেন একজন মহিলা কাউন্সিলর।
প্রতিবেদনের মন্তব্যে অবশ্য সেই সময় কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তা নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা করা হচ্ছে, এসব অভিযোগ মিথ্যা।
এই সংবাদের পর কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তার অনুসারী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেয় পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ কিছুদিন ভালো থাকলেও ২২ সালের ৬ আগস্ট পুনরায় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়” কাউন্সিলরের বাসায় আটকে রেখে ব্যবসায়ীকে মারধরের অভিযোগ” শিরোনাম হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নুর হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী ও তার ছেলেকে সাভার পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সানজিদা শারমিন মুক্তার বাসায় আটকে রেখে লাঠি দিয়ে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী সাভার পৌর এলাকার একতা প্রিন্টিং প্রেসের মালিক।
বা বু ম/ এস আর