ময়মনসিংহ প্রতিনিধিঃ
ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহ্যবাহী হরিকিশোর রায় রোডে অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত সরকারি ভবন ভাঙাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি শহরে নানা ধরনের গুঞ্জন ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই এই ভবনটিকে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটে বলে ধারণা করছেন। অথচ ইতিহাস ও দলিল ঘেঁটে দেখা যায়, এই দাবির কোনো প্রমাণভিত্তিক ভিত্তি নেই।
সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস
সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষরা ভারতের নদীয়া জেলা থেকে বর্তমান বাংলাদেশের শেরপুর জেলার যশোদলে আসেন। তাঁর অষ্টম পুরুষ রামসুন্দর দেব শ্বশুরের জমিদারি দেখভাল করতে এসে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় জমিদারি বিস্তার করেন। এই বংশের তৃতীয় প্রজন্ম রমাকান্ত দেব কিশোরগঞ্জের মসুয়ায় নির্মাণ করেন জমিদার বাড়ি—যেখানে উপেন্দ্রকিশোর রায়ের জন্ম।
উপেন্দ্রকিশোর রায়ের (আসল নাম কামদারঞ্জন দেব) শৈশব কাটে ময়মনসিংহ শহরে হরিকিশোর রায়ের দত্তকপুত্র হিসেবে। তিনি বসবাস করতেন ‘পূর্ণলক্ষ্মী ভবন’ নামে পরিচিত একটি বাড়িতে, যা এখন আর বিদ্যমান নেই। ভবনটি ১৯৪৮ সালে বিক্রি করে দেওয়া হয় এবং বর্তমানে সেখানে গড়ে উঠেছে আধুনিক ‘দুর্লভ ডালিয়া টাওয়ার’।

যে ভবনটি ভাঙা হচ্ছে, সেটি রায় পরিবারের নয়
বর্তমানে যেটি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির নামে বরাদ্দপ্রাপ্ত ভবন এবং ভেঙে ফেলা হচ্ছে, সেটি মূলত ১৯২০-এর দশকে নির্মিত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে। জমিদার শশীকান্ত আচার্য্যের একটি পুরাতন ভবন রণদাপ্রসাদ সাহা কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার শুরু করেন, যা পরে East Pakistan Power Board এবং এরপর জেলা পরিষদের অধীনে আসে।
১৯৮৭ সালে ভবনটি শিশু একাডেমির নামে বরাদ্দ পায় এবং ২০০৭ সালে এটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে একাডেমির দীর্ঘমেয়াদি লিজ চুক্তি হয়। সবশেষে, ২০২৪ সালে জেলা কনডেমনেশন কমিটির সুপারিশে ভবনটি ভাঙার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
তথ্য-ভ্রান্তির উৎস কোথায়?
উভয় ভবনই হরিকিশোর রায় রোডে অবস্থিত হওয়ায়, নামের মিল এবং দত্তক সূত্রে পারিবারিক ইতিহাস জানার অভাবে জনমনে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, শিশু একাডেমির ভবনটির সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোর বা সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের কোনো সংযোগ নেই।
ইতিহাস সংরক্ষণের দায় কার?
এই ঘটনাটি আমাদের সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে—ইতিহাস আমরা কিভাবে সংরক্ষণ করি? শুধুমাত্র নাম বা লোককথার ওপর নির্ভর করে নয়, বরং দলিল, প্রমাণ ও প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করেই একটি জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষা করা সম্ভব।
সত্যজিৎ রায়ের নাম যেমন আমাদের গর্ব, তেমনি তাঁর সঠিক ইতিহাস রক্ষাও আমাদের দায়িত্ব। ভুল তথ্য ও আবেগ যেন সত্যকে আড়াল না করে দেয়—এই সচেতনতা জরুরি।