নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকার সাভারে একটি স্থানীয় সালিশি বিচারকে কেন্দ্র করে রবিউল হাসান মোহন (১৫) নামের এক স্কুল শিক্ষার্থী কিশোর আত্মহত্যা করেছে।
শুক্রবার (৮ এপ্রিল) সকাল ১১ টা ১০ মিনিটে আউকপাড়া আদর্শ গ্রাম এলাকায় এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
নিহত ওই স্কুল শিক্ষার্থীর বাবা ভোলা জেলার সদর থানার বাপতা ইউনিয়নের মোছাকান্দি গ্রাম থেকে এক যুগ পূর্বে সাভার উপজেলার আউকপাড়া আদর্শ গ্রাম এলাকায় একটি সরকারি প্লট লিজ নিয়ে বড় ছেলে সুমন , ছেলের বউ , ছোট ছেলে মোহন (১৫) ও দুইজনের মধ্যে এক প্রতিবন্ধী মেয়ে সহ বসবাস করে আসছেন। ইউসুফ আলীর স্ত্রী লঞ্চ দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। সেই লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
নিজেকে আত্মহুতি দেওয়া কিশোর রবিউল হাসান মোহন স্থানীয় একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী । সে তার সহপাঠী ও প্রতিবেশী এক স্কুলছাত্রীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে । এর সূত্র ধরেই মূলত সালিশে বসেন স্থানীয় মোড়লরা। ওই সালিশি ব্যবস্থায় কিশোর মোহনকে মারধর করা হয় । মোহনের ভাই সুমনকে কান ধরে উঠবস করানো হয়। এতেই ক্ষান্ত হয়নি স্থানীয় মোড়লরা, কিশোর মোহনের বোন এবং বোন জামাই সহ মোহনের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলীকেও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও মারধর করা হয় ।
মৃত্যুর পূর্বে নিহত মোহন একটি চিরকুট লিখে নিজেকে আত্মহুতি দেন, এই চিরকুট এর সূত্র ধরে আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক । চিরকুটে লেখা ছিল, সুমন্যা তোমাকে কত ভালবাসি তুমি তা জানো, তিনদিন ধরে কেন তুমি কথা বলোনা । তোমার বাবা ঢাকায় পাঠিয়ে দিল আর আমাকে রেখে তুমি চলে গেলে, আমি তা সহ্য করতে পারছিনা।
নিহত কিশোরের বড় ভাই সুমনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য। আল্লাহ আমাদের প্রতি মনে হয় ব্যাজার’ মা’কে ছোটবেলায় একটি দুর্ঘটনায় হারিয়েছি। গত সাড়ে তিন বছর পূর্বে আমার প্রতিবন্ধী বোনকে প্রতিবেশী এক জানোয়ার ধর্ষণ করেছিল । এ ঘটনায় একটি মামলা হয়। কিন্তু আসামী গ্রেপ্তার হয়নি । এর পর থেকেই আমরা অনেকের চক্ষুশূল। হঠাৎ আমার ভাইটা আমাদের রেখে চলে গেল।
এর পেছনের কারণ জানতে চাইলে সুমন বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দুলাল মিয়ার মেয়ে সুমন্যার সাথে ছোট ভাই মোহন এর করোনাকালীন সময় থেকে গত দুই বছর যাবত প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনিয়মিত পড়ালেখায় তারা আরও আসক্ত হয়ে পড়ে । পুরো এলাকাটা এমনিতেই মাদকে সয়লাব, এর প্রভাবতো কিছুটা তার উপর আছেই।
আমরা পরিবার থেকে দুই পক্ষ দুই জনকে শাসিয়েছি। এতে গত কয়েকদিন যাবত সম্পর্কে ভাটা পড়েছে তাদের। মেয়েটিকে তার বাবা ঢাকায় নিয়ে তার আত্মীয়ের বাসায় রেখেছে। এ থেকে গত বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) আমার ভাই এই দুঃখে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে । পরে এলাকায় জানাজানি হয়। সেদিন দুলাল মিয়ার পরিচিত কয়েকজন আমার ভাইকে চড় থাপ্পড় মারে এবং ক্লাবে বিচার দেয়।
পরের দিন ( শুক্রবার ৮ এপ্রিল ) সকাল আটটার দিকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানা থেকে টেনে হিচড়ে উঠিয়ে আউকপাড়া আদর্শ গ্রাম এর বাস্তহারা সেবা সংঘ ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয় । প্রথমে বিষয়টি আমরা টের পাইনি । আমাদের কেউ ডাকেও নি । আমার স্ত্রী আমাকে ঘুম থেকে ডেকে দিলে আমি, আমার বাবা, আরেক ছোট বোন ও বোনজামাই ক্লাবে গিয়ে দেখি মোহন কে নিয়ে সালিশ করা হচ্ছে ।
সুমন আরও বলেন, বিচারের সময় অপু মিয়া, আজিজ মিয়া, সেলিম মিয়া, কবির হোসেন, নাসিমা বেগম সহ ওই ক্লাবের সভাপতি আব্দুল হালিম ও তার সমর্থক ১০ /১৫ জন ছিলেন।
ভাইয়ের অপরাধে তারা আমাকে কান ধরে উঠবস করায়, বোন ও বোন জামাইকে অপমান করে । ছোট ভাই মোহন কে মারধর করে । আমার বাবাকেও অপু মিয়া লাঠি দিয়ে বাড়ি মারে। তারা যদি আজ এটা না করতো তাহলে আমার ভাই কোনদিন মরতো না। তারা আমার পরিবারের বিচার করেছে, তাদের বিচার কি আল্লাহ করবে.? এই বিচার আমি কার কাছে চাইব। যদি বিচারের বিষয়ে মুখ খুলি তাহলে আমাদের এলাকা ছাড়া করবে ।
নিহত কিশোরের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী বলেন, আমাকে তারা ধ্বংস করে দিয়েছে । আমার ইজ্জত ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে। এর আগে অপু মিয়া আমাকে বিনা দোষে মেরেছে । আমার ছোট ছেলেটা একটু দুষ্ট প্রকৃতির তবে আমাদের কি দোষ ছিল । মোহনের কারণে আমার পরিবারের প্রতি অন্যায় বিচার করেছে তারা। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে আমার ছেলেটা আজ তাদের কারণেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিল। এ ঘটনায় আমি সুষ্ঠু বিচার চাই । তবে তারা তো অনেক প্রভাবশালী, ছেলেটার মৃত্যুর পর থেকেই আমাদের সবাইকে তাদের লোকজন সর্বদা নজরে রেখেছে । আমি তাদের নামে বিচার দেওয়ার সাহস পাচ্ছি না ।
এ ব্যাপারে আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক আওয়াল শনিবার সকালে বলেন, গতকাল খবর পেয়ে আউকপাড়া আদর্শ গ্রাম থেকে এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। পরিবারের অভিযোগ না থাকায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর আগে শুক্রবার রাতে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, যদি পরিবার অভিযোগ করে আমার ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে ।