নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা: সাভারে এক ছাত্রলীগ নেতার দ্বারা চৌদ্দ বছরের এক কিশোরী ২৭০ দিনে অন্তত প্রায় ৯৬ বার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এই ঘটনার নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) ওই কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে সাভার সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানার বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা রুজু করা হয়েছে (মামলা নং-৬৫)।
চাঞ্চল্যকর এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক শহিদুল ইসলাম।
এর আগে বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে সাভার মডেল থানায় কন্যা (১৪) কে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণে সোহেল রানাকে প্রধান অভিযুক্ত করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী কিশোরীর মা।
অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা সোহেল রানার বিরুদ্ধে এর আগেও নারী কেলেঙ্কারি, প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে প্রতারণা, হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর, চাঁদাবাজিসহ আরও বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে । মামলার পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে সোহেল রানাকে গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ৯ মাস আগে থেকে ভুক্তভোগীকে কু-প্রস্তাব দিয়ে আসছিল সাভার সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানা। তার এমন প্রস্তাবে অপ্রাপ্ত চৌদ্দ বছরের কিশোরি রাজি না হলে গত বছর ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর ভুক্তভোগীকে রাস্তা থেকে হাত ধরে জোর করে ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় অভিযুক্ত সোহেল রানা।
এসময় অভিযুক্ত তার সাভার পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের মজিদপুর রাজার বাড়ী এলাকার ভাড়া করা ফ্ল্যাটে ওই কিশোরিকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হলে হত্যার হুমকি দেয় সোহেল রানা। ভয়ে ওই কিশোরী এতদিন মুখ খোলেননি। কিছু না বললে পরবর্তীতে আবারও একই কায়দায় চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগীকে ধর্ষণ করে। বিষয়টি ভুক্তভোগী তার মাকে জানালে সাভার মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন তার মা।
এদিকে ভুক্তভোগী কিশোরীর সাথে এক নারী প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়। ভুক্তভোগী জানান, তার বাসার পাশে সাভার পৌরসভার মজিদপুর রাজারবাড়ী সংলগ্ন ছাত্রলীগ নেতার অফিস। ২০২১ সালের দিকে প্রথম পরিচয় হয় সোহেল রানার সাথে।
রাস্তায় যাতায়াতের বিভিন্ন সময়ে ভুক্তভোগীকে অনৈতিক আকার-ইঙ্গিত প্রদর্শন করত অভিযুক্ত। এক পর্যায়ে প্রেমের প্রস্তাব দেয় ওই কিশোরীকে। সে তা প্রত্যাখ্যান করলে জোরপূর্বক সোহেল রানার ভাড়া করা ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করে। এ সময় অশালীন ছবি তুলে ভিডিও ধারণ করে রাখে সোহেল রানা। সেই ভিডিও দেখিয়ে এবং বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এত দিন ধর্ষণ করে আসছিল অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা সোহেল রানা। কয়েকবার অস্বীকৃতি জানালেও ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে ওই ভুক্তভোগী কিশোরীকে। ১৪ ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে তার সাথে সময় কাটানোর প্রস্তাব করে ছাত্রলীগ নেতা সোহেল রানা। ভুক্তভোগী কিশোরী সেদিন না যেয়ে বিয়ের ব্যাপারে পরিবারের সাথে কথা বলতে বলেন। সোহেল রানা তাকে বিয়ে করবে না বলে জানিয়ে দেন। আবারো পরদিন চলতি বছরের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি তার গতিরোধ করে একই কায়দায় জোরপূর্বক ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। এতে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাসায় এসে ওই কিশোরী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিশোরীর মা আত্মহত্যার কারণ জানতে চাইলে বিষয়টি খুলে বলে ভুক্তভোগী কিশোরী। পরে তাকে বুঝিয়ে সভার মডেল থানায় মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার।
এই ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে সাভার উপজেলা ছাত্রলীগ। প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় সাংগঠনিকভাবে সাভার সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার(২৪ ফেব্রুয়ারি) রাতে সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক ও সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ কবির স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সাভার সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানাকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। সংগঠন থেকে তাকে স্থায়ী বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে সুপারিশ করা হলো। এছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় সাভার সদর ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের কমিটিও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।
এ বিষয়ে সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক বলেন, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সম্প্রতি সোহেল রানা সাংগঠনিক কার্যক্রমে স্থবির হয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ছাত্রলীগ। তাকে কেন্দ্রীয়ভাবে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মাকারিয়াস দাস বলেন, অপরাধী যেই হোক তার অপরাধের শাস্তি অবশ্যই তাকে পেতে হবে। উর্দ্ধতন অফিসারের নির্দেশে ধর্ষণ মামলার আসামিকে গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে,সাভার সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানার বিরুদ্ধে যৌন কেলেংকারী নতুন নয়। এর আগে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ২০১৪ সালে মামার বাড়ি আশুলিয়ার বেবজা এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে পরিবার নিয়ে সাভার সদর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের চাপাইন এলাকার বাসিন্দা ইউনুস আলীর বাসা ভাড়া নেয়। এরপর শুরু হয় মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ। তার মাদক কারবারিতে জড়িয়ে এলাকার উঠতি বয়সের কোমলমতি তরুণ সমাজ সর্বনাশী ইয়াবায় আসক্ত হয়। মাদক চোরাচালান কালে ২০১৫ সালে মাদকসহ সাভার মডেল থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় সোহেল রানা। মাদক কেলেঙ্কারির ঘটনা জানাজানি হলে সেখান থেকেও এলাকাবাসী তাদের বিতাড়িত করে।
এরপর সাভার পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের সামসু মিয়ার বাড়িতে বাসা ভাড়া নেয় সোহেল রানা ও তাঁর পরিবার। সেখানে বাসার মালিক সামসু ভাড়া চাইলে তাকেও ভাড়া না দিয়ে উল্টো মাদক দিয়ে জড়িয়ে মামলা দেওয়ার কথা বলে জিম্মি করে তার উপর চাঁদা দাবি করে সোহেল রানা। বাসার মালিক শামসু তার উপর অত্যাচারিত হওয়ার বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে সাভার পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি হাফিজ উদ্দিন এর কাছে বিচার চায়। সালিশে না গিয়ে বাসার মালিক বৃদ্ধ সামসু কে বেধড়ক মারধর করে ভাড়া না দিয়ে আসবাবপত্র ও মালামাল নিয়ে চলে যায়।
এরপর ডগরমোড়া উদয়ন স্কুলের পাশে সাভার মডেল কলেজের শিক্ষক বিল্লাল হোসেনের বাড়িতে ভাড়ায় উঠে। সেখানে বসবাস করা অবস্থায় সাভার সদর ইউনিয়নের দেওগাঁও এলাকার মতি মিয়ার ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী কুটু মিয়া(২১) কে কুপিয়ে জখম করে । মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও কুটু তার স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া সাভার মডেল থানায় করা মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এর কিছুদিন পূর্বে সাভার পৌর সভার সিআরপি এলাকার বাসিন্দা যুবলীগ নেতা জনিকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে জখম করে হাসপাতালে পাঠায়। এ ঘটনায়ও সাভার মডেল থানায় একটি মামলা হয়। সেই মামলাও আদালতে বিচারাধীন।
শিক্ষক বিল্লাল হোসেনের বাড়িতে ভাড়া না দিয়ে ডগরমোড়া এলাকার পল্লী চিকিৎসক মোকলেস ফার্মেসীর সামনে বাসা ভাড়া নেয়। এরপর আর পিছন ফিরে তাকায়নি এই ছাত্রলীগ নেতা। সাভার সদর ইউনিয়নের ছাত্রলীগ সভাপতির পদ পাওয়ার পর চাপাইন এলাকায় বাড়ি করার জন্য একটি প্লট, সাভারের বংশী নদীর পাড়ে জমি ও রেডিমেড বাড়ি ক্রয়, সাভার ল্যাব জোন হাসপাতাল সংলগ্ন জুয়েল নামে এক ব্যক্তির বাড়ি দখল করে নানা রকম অপকর্ম করে আসছিল এই সোহেল রানা। ডান্সার রানা নামেও সে পরিচিত। সাভারের প্রভাবশালী মানুষের ছেলে মেয়ের বিয়ে এবং সামাজিক অনুষ্ঠান গুলোতে নাচের ডাক পড়তো সে এবং তার নিত্য পরিবেশন দলের। এভাবে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। ডান্সার টিমের নিত্য পরিবেশন করা উঠতি বয়সী মেয়েদের ভুল বুঝিয়ে ব্যবহার করে উচ্চ বিলাসী ধনীর দুলালদের প্রেমের ফাঁদে ফাঁসিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতো সে। এভাবেই সে হয়ে ওঠে কোটি টাকার মালিক। পাবনা জেলার আহমদ আলীর দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে সোহেল রানা। এর আগে আহমদ আলীর ছোট ছেলে সুমন রানা বঙ্গবন্ধু ব্রিজ সিরাজগঞ্জ মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।