অ আ আবীর আকাশ :
রাজার সভাসদে পন্ডিত রাখতেন অত্যান্ত সমর্যাদায়। পন্ডিতকে ‘গুরুদেব তুল্য’ ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন রাজা। যে কোনো বিষয়ে পন্ডিতের সাথে আলোচনা করে বুদ্ধি নিতেন। তারপর রাজা মঙ্গল শোভাযাত্রায় অগ্রসর হতেন। রাজনীতি পাঠ করতেও রাজনৈতিককর্মীরা পন্ডিত জ্ঞানী-গুণীদের নিকট বসে থাকতেন দিনের পর দিন, মাসের-পর-মাস, বছরের পর বছর। পা ছুঁয়ে সালাম আদাব করতেন। রাজনীতির শুভ সুচনা হতো পন্ডিতদের আখড়া থেকে।
দেশ উন্নয়নে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা যতো না, তার বেশি অবদান বা ভূমিকা যা-ই বলি পণ্ডিতদের। তাদের এ গর্ব সবটুকুই দিতে চাই। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বুদ্ধি, পরামর্শ সব পন্ডিতদের কাছ থেকে নেয়া হতো আগে।
সময়ের পালাবদলে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কান্ডহীন সিদ্ধান্তগুলো যাচ্ছেতাই হচ্ছে। নিজেদের পন্ডিত ভাবতে শুরু করায় এখন আর পণ্ডিতদের ধারে কাছে ঘেঁষতে নারাজ। ‘বড় ভাই’ খ্যাত দু-একজনের তাঁবেদারী করলে, গাছে গাছে কল্লার ছবি টাঙালেই কর্মীগুলো মনে করে নিজেরা বড় নেতা বনে গেছে।-আসলে রাজনীতি বলতে কি? রাজনীতি কারা করে? কেনো করে? তা বোঝেই না সাড়ে ১৫ আনা রাজনীতি নিয়ে দৌড়ানো পোলাপাইনেরা। তারা রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা নিতে চায়না। শিখতে চায় না। অল্প সময়ে নেতা হতে চায়। নেতৃত্বে আসতে চায়। টাকা কামানোর কল হিসেবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পোলাপাইনেরা অনেক সময় বিগড়ে যায়, স্বপ্ন ভ্রম ঘটে তাদের।
রাজনীতির কালো বিড়ালকে সবাই পোষ মানাতে পারে না। সবার কাছে ধরাও দেয় না। সময়, নিয়মানুবর্তিতা, মেধা, শিক্ষা, সততা, আদবকেতা ও চালচলন কোনোটাই লক্ষ্য করা যায় না রাজনীতি নিয়ে লাফানো কোনো ছেলে মেয়েদের মাঝে। তাতে করে উশৃংখলতা ও বেহায়াপনা যেমন গ্রাস করেছে, তেমনি অর্থনৈতিক চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে বলে নানা অনিয়মে জড়িয়ে যায়। এতে করে নীতি-নৈতিকতা থেকে রাজনীতি বহুদূর চলে গেছে।
ছাতা হিসেবে যারা থাকে, সেসব বড় ভাই খ্যাতরা রাজনীতির মাঠ দখল করে রাজনৈতিক শিষ্য তৈরি না করে বাহিনী পোষে। বাহিনী দিয়ে যতো অন্যায় কাজগুলো করিয়ে থাকে। এদের অন্যায় কাজে সক্রিয় হতে গিয়ে কতোগুলো জওয়ান পোলাপাইনের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়, কতো নিরীহ মায়ের স্বপ্ন অল্প সময়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এসব বড় ভাইদের কাছে শিক্ষণীয় কিছুই নেই। তবে মাঝে মাঝে অবৈধ কাজ সম্পাদনের ফলে হাতখরচ পাওয়া যায়। এতে খুদ কুড়া খেয়ে জীবন ছারখারে বইয়ে দেয়ার কী কোনো যুক্তি আছে?
২.
রাজনৈতিক নেতাদের আগে কি চমকপ্রদ সম্মান ছিলো। তারাও সাধারণ জনগণকে সালাম, শ্রদ্ধা করতেন। কথাবার্তায় ছিলো দারুণ আদাবকেতা। যেমন তারা অন্যদের মূল্যায়ন করতেন, তেমনি আবার সাধারন জনতাও রাজনৈতিক নেতাদের সম্মান প্রদর্শন করতেন। আজ সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক পদ-পরিচয়ে তেমন আর সম্মান পাওয়া যায় না। কেউ মূল্যায়ন করে না। কোথাও কোনো টেবিলে রাজনৈতিক পরিচয় দিলে কলা পাতার মতো পানসে হয়ে ওঠে পরিবেশ। কোনো এমপি, মন্ত্রী, কোনো পদ-পদবীধারী কারোরই সম্মান অটুট নেই। কিন্তু কেনো?
সম্মান, সালাম, আদাব ও মূল্যায়ন পান না বলে সম্প্রতি বাংলাদেশের সংসদে এ নিয়ে ভোলার সাংসদ তোফায়েল আহমেদ কথা তুলেছেন। তোফায়েল আহমেদ আওয়ামীলীগের সিনিয়র ও বর্ষিয়ান নেতা। তিনি রাষ্ট্রনায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া কমিটির সদস্য। তোফায়েল রাজনৈতিক উত্থান পতনের সাথে সাথে নিজেকে অভিজ্ঞ করে তুলেছেন। তবে সংসদে তার যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাতে করে সচেতন নাগরিক তথা বাংলাদেশের আমজনতা নড়েচড়ে বসেছে। চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছে পুরো জাতিতে। আমলারা এখন আর রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করতে চায় না। তারা কোনো রাজনৈতিক নেতার কথা, চিঠি, ডিও লেটার, ফোন বা সরাসরি ফরমায়েশ রাখতে চায় না, রাখে না।
কেনো আমলারা রাজনৈতিক নেতাদের অবমূল্যায়ন করে? তার যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা কি হতে পারে?
রাজনৈতিক মাঠে যে অসুস্থধারা, অসুস্থ প্রতিযোগিতার আবির্ভাব ঘটেছে তাতে আমলারা এর সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করছে। আমলারা মনে করছে-‘রাজনৈতিক নেতাদের সাপোর্টে জনগণ নেই।’ তাদের সাপোর্টে জনগণ থাকলে তো আর আমলা দিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হতো না। নেতা যখন আমলারা বানায় তবে আর এতো শোনা-শুনি কিসের! সে কারণে বোধহয় আমালাদের কাছে রাজনৈতিক নেতা, এমপি, মন্ত্রীদের সম্মান ম্রীয় হতে চলেছে। কারণ এমপি, মন্ত্রি তো আমলারাই ভোট কাটিয়ে বানায়। সে কারণে বোধহয় তারা মূল্যায়ন করতে চায় না। নেতার দাপুটে নেতাগিরি তো ভোটের মাঠে ফল ফলে না। তাহলে রাজনৈতিক নেতার মূল্য কী রইলো? ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসিল্যান্ড, পুলিশ-আনসারসহ আরো নানা জাতের আমালাদের উপর ন্যস্ত থাকে রাজনৈতিক নেতার নেতাগিরি। তাহলে যে নেতা তৈরি হতে এতো জনের উপর ভর করে, সে নেতাকে কে স্যার স্যার বলে লুটে পড়বে?
৩.
পন্ডিতবরদের কদর, সম্মান লুপ্ত হওয়ার পর রাজনীতি চলে এসেছে মূর্খ, অর্ধ শিক্ষিতদের হাতে। বাঁক খেয়ে রাজনীতি উঠেছে ব্যবসায়ীদের দোকানে। ব্যবসায়ীরা নিরেট ব্যবসা করে টাকার মালিক, কিন্তু রাজনীতির মাঠে জিরো। রাজনীতির ‘রা’ না জেনেও এতে তারা নিজেরাই নিজেদের গুণী ভাবতে শুরু করেছে। সম্মানপ্রাপ্তরা রাজনৈতিক চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় রাজনীতির মাঠে গণতন্ত্র খুন হয়েছে। জোতদারী শাসনামলে নিজেদের ক্ষমতা, চেয়ার ও পদ-পদবী পাওয়ার হীনমানসিকতায় গণতন্ত্র বা ‘জনতা ভোটাধিকার বঞ্চিত’ হওয়ায় আজ আমলারা সুযোগ পেয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ঘাড়ে চেপে বসে তারা ফাঁয়দা লুটে খাচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে! এতে দেশ ও দেশের জনগণের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অন্ধকারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এর থেকে উত্তরণের পথ কী? সঠিক পথের সন্ধান করে যথাযথ ভাবে না এগোলে নিশ্চিত বড়ো কোনো দুর্ঘটনার দিকে এগোচ্ছে দেশ। সে দায়মোচন করা সম্ভব নাও হতে পারে।★