সাকিব আসলাম
ঘটনার শুরু মোটরসাইকেলের হর্ণ বাজানোকে কেন্দ্র করে। অতঃপর ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী নিয়ে গ্রামে ঢুকে হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট। বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হামলার শিকার হওয়া সাধারন মানুষ। গ্রামে হামলা চালিয়ে উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন স্থানীয় এক চেয়ারম্যান। তবে পরিবার কেন্দ্রিক নয় সেটা ২০১৮ সালের একটি রাজনৈতিক মামলায়। আবার ওসির দাপটে পুরো এলাকাটি এখন পুরুষ শূণ্য। ঘটনাটি বগুড়ার প্রত্যন্ত একটি গ্রামের। সেই এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালী বহিস্কৃত বিএনপি নেতা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী। পিছন থেকে সহযোগীতার অভিযোগ রয়েছে সোনাতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিরুদ্ধেও।
জানা যায়, বগুড়া জেলার সোনাতলা উপজেলার চরপাড়া বাজারে গত ৩’রা মার্চ মোটরসাইকেলের হর্ণ বাজানোকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরেন দুই যুবক। পরে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে মহড়া দিয়ে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে তারাবির নামাজরত অবস্থায় পুরো একটি গ্রামে হামলা চালায় জোড়গাছা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও বিএনপি’র বহিষ্কৃত নেতা গোলাম রব্বানী ও তার নেতৃত্বে থাকা ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা। হামলার ঘটনায় আহত হয় কমপক্ষে ১০জন গ্রামবাসী। ঘটনার দুদিন পর গ্রামের নারী পুরুষসহ ২৪ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও ৬০জনের নামের পাশে আওয়ামী লীগ ট্যাগ দিয়ে রাজনৈতিক মামলা করেন অভিযুক্ত এই চেয়ারম্যান। কোন ধরনের তদন্ত না করেই মামলা নথিভুক্ত করেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এদিকে আসামীদের অধিকাংশ ব্যক্তি স্থানীয় জামায়াত এবং বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও এজাহারে তাদের নামের পাশে উল্লেখ করা হয়েছে যুবলীগ ও আওয়ামীলীগের কর্মী হিসেবে। এছাড়া এই এজাহারে উল্লেখিত আসামীরা গ্রামের নিরীহ ও সাধারণ মানুষ। শুধু তাই নয় দীর্ঘ দিন এলাকার বাহিরে থাকা ও অসুস্থ মানুষের নামও এই মামলায় আসামী হিসেবে রাখা হয়েছে। মামলার ২০ নং আসামী গোলাপ মিয়া ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত রয়েছেন, দীর্ঘদিন যাবত তিনি এলাকায় নেই। এছাড়াও ২১ নং আসামী আব্দুর রশিদ দীর্ঘদিন ধরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাসায় চিকিৎসাধীন আছেন। অভিযুক্ত চেয়ারম্যান নিজেই বলছেন মামলার ২নং আসামী শিমরুল এবং ৫নং আসামী সাকিরুলসহ বেশ কয়েকজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়রা জানায়, চেয়ারম্যানের ভাতিজা রিফাত ও গোসাইবাড়ি গ্রামের রাশিদুল ইসলামের সাথে ঘটনার সূত্রপাত। চরপাড়া বাজারে মোটরসাইকেলের হর্ণ বাজানোকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরেন তারা দুইজন। একপর্যায়ে চেয়ারম্যানের ভাতিজা রিফাত ও সিঙ্গাপুর প্রবাসী রাশিদুল এর মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে ঘটনাটি জানাজানি হলে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা গোলাম রব্বানী তার দলবল নিয়ে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে স্থানীয় চরপারা বাজারে আসেন। এসময় বাজারে রাশিদুলকে না পেয়ে তারাবী নামাজ চলাকালীন সময়ে গোসাবাড়ি গ্রামে ঢুকে পড়েন। সেখানেও তাকে না পেয়ে বাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট শুরু করেন। এসময় বাড়িতে থাকা রাশিদুলের মা সহ বেশ কয়েকজন নারী বাধা দিলে তাদেরকে ছুরিকাঘাত করে আহত করা হয়। এতে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরলে নামাজ শেষে মুসল্লিরা তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায় চেয়ারম্যানের লোকজন। পরে পুরো গ্রামের মুসল্লিরা ও স্থানীয় মানুষজন একত্র হয়ে ধাওয়া দিলে চেয়ারম্যান তার লোকজন নিয়ে পালিয়ে যায়। এঘটনায় গ্রামের কমপক্ষে ১০জনকে আহত অবস্থায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে ঘটনাস্থল বেশ কয়েকবার পরিদর্শন করে সোনাতলা থানা পুলিশ। এ ঘটনার পর মামলা হয়েছে তবে মামলার আসামী সবাই গ্রামবাসী। তাছাড়া বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীসহ জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও মামলায় বানানো হয়েছে যুবলীগ ও আওয়ামীলীগের কর্মী। এদিকে চেয়ারম্যান নিজেই বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত। সে আওয়ামীলীগের সাথে মিলে ইউপি নির্বাচন করেছে। আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের সাথে এখনও সক্ষতা রয়েছে তার।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আলহাজ্ব কাজী রফিকুল ইসলামের নির্বাচনী বহরে হামলা করে এলাকার যুবলীগ নেতা কর্মীরা। এ সময় বেশ কিছু গাড়ী ভাংচুর ও মারপিট করা হয়। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এ কেএম আহসানুল তৈয়ব জাকির এর নির্বাচনী বহরে একই ব্যক্তিরা মারপিট ও ভাংচুর করে। উক্ত গাড়ী বহরে চেয়ারম্যানসহ ভাতিজা রিফাত এবং দলীয় নেতা কর্মীদের উপরও হামলা করা হয়। সেই ঘটনার রেশ ধরেই রিফাতকে আটকে রেখে মারপিট করে এবং তার কাছে থেকে ব্যবসার নগদ ৩ লাখ টাকা নিয়ে যায়। পরবর্তীতে আরও টাকা দাবী করলে চেয়ারম্যান লোকজন নিয়ে দেখতে আসেন। এসময় আসামীরা তাদের হাতে থাকা হাসুয়া, ধারালো ছোরা, রাম-দা, চাইনিজ কুড়াল, লোহার রড, এস এস পাইপ, বাঁশের লাঠি ইত্যাদিসহ দেশীয় অস্ত্রে সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের উপর হামলা করে আহত করে। কিন্তু পুরো ঘটনা মিথ্যা ও সাজানো দাবী করে সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছেন স্থানীয়রা।
এ ব্যাপারে গ্রামের ঘটনাস্থলে থাকা স্থানীয় বাসিন্দা ও ৪ নং ওয়ার্ড জোড়গাছা ইউপি জামায়াত কর্মী বিপ্লব ইসলাম তাইফুল বলেন, আমরা নামাজ পরছিলাম। এসময় চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী তার লোকজন নিয়ে আমাদের গ্রামে এসে হামলা চালায়। বাহিরে ডাকাতির চিৎকার শব্দ পেয়ে নামাজ সংক্ষিপ্ত করে বাহিরে আসলে তারা আমাদের উপরও অতর্কিত হামলা চালায়। এ ঘটনার পর উল্টো আমাদের আওয়ামীলীগ কর্মী বানিয়ে মামলা দিয়েছে।
মামলার অপর আসামী মামুন মিয়া জানান আমি দীর্ঘদিন ধরে যুবদলের রাজনীতির সাথে জড়িত এবং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি পদপ্রার্থী। তবুও আমার নামে চেয়ারম্যান মিথ্যাচার করেছে। আমাদের গ্রামে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও দলবল নিয়ে অবৈধ ভাবে প্রবেশ করে ডাকাতির উদ্দেশ্যে লুটপাট, হামলা ও ভাংচুর সহ ছুরিকাঘাতের মত ঘটনা ঘটিয়েছে। আবার উল্টো আমাদের নামে আওয়ামীলীগের ট্যাগ লাগিয়ে থানায় মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমরা এই মামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। সেই সাথে মামলা প্রত্যাহারের দাবী জানাই। তা না হলে আমরা গ্রামবাসী ও নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে মিথ্যা নাটকের কঠিন জবাব দেওয়া হবে।
ঘটনার ব্যাপারে অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানীর সাথে যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ওই এলাকার মানুষ সুদের ব্যবসা করে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আছে। তারা আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের উস্কানিতে আমাদের উপর হামলা চালায়। আমি তার জন্য একটি সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছিলাম। সেই থেকে আমার ও আমার পরিবারের উপর তাদের ক্ষোভ ছিল। সেদিন আমার ভাতিজা বাসায় ফেরার পথে তাকে আটকে রাখে। তাকে উদ্ধার করতে গেলে আমার উপর অতর্কিত হামলা চালায়।
তিনি আরও বলেন, ঘটনাস্থলে শিমুল এবং সাকিরুল নামে দুই আসামীর নাম দেয়া হইছে আমি তখন চিকিৎসা কাজে ব্যাস্ত ছিলাম। ২নং আসামী শিমুল এবং ৫ নং আসামী সাকিরুল আমাকে জনতার রোশানল থেকে সেভ করে এবং তাদের বাসায় আশ্রয় দেয়। আমাকে তাদের বাসায় তোলার কারনে জনগন তাদের বাসায়ও হামলা করে। তাই প্রশাসনের সাথে কথা বলে শিমুল ও সাকিরুলসহ যারা জড়িত ছিলো না তাদের নাম বাদ দেবার ব্যাবস্থা করবো।

এ ব্যাপারে সোনাতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিলাদুন নবী ঘটনার প্রথম দিকে গ্রামে ঢুকে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা অস্বীকার করেন। পরে পুলিশ সুপারের নির্দেশে মামলা হলে তিনি জানান, এটা একটি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে। কোন রাজনৈতিক ঘটনা নয়। তবে শুরু টা তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে। দু-পক্ষের মধ্যেই ঝামেলা হয়েছে। দুপক্ষের আহত হয়েছে। চেয়ারম্যান একটু প্রভাবশালী। তার ভয়ে এলাকায় পুরুষ কম। তবে আমরা কোন অভিযান চালাচ্ছি না। যেহেতু কিছু ভুল ব্যাখা আছে তাই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রাথমিক তদন্ত ছাড়া মামলা কেন নিয়েছেন জানতে চাইলে ওসি বলেন, আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। প্রাথমিক ভাবে দুপক্ষের কথা শুনেছি।
রাজনৈতিক বিষয় এজাহারে উল্লেখ করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনিও মামলা করতে পারেন। তবে মামলাটাকে শক্ত করার জন্য এই ব্যাখা দিয়েছেন তিনি। আমরা তদন্ত করবো। সেভাবেই চার্জশিট জমা দিবো।
এবিষয়ে বগুড়া জেলার সোনাতলা ও শিবগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ নাজরান রউফ বলেন ঘটনাস্থলে আমি নিজে গিয়েছি। গ্রামে হামলার ঘটনায় অভিযোগ হলেও প্রথমে মামলা নেয়া হয় নি এমন অভিযোগ পাওয়া যায়। পরে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার স্যারের নির্দেশে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গ্রামে ঢুকে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটসহ বেশ কয়েকজন আহতের তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ওসিকে মামলা দেবার নির্দেশ দেয়া হলে থানায় চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানীসহ ৯জনের নাম উল্লেখসহ ২০-৩০ জনের নামে মামলা হয়।
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত হলেও রাজনৈতিক মামলা নেওয়া হয়েছে এ কারণে ওসির বিরুদ্ধে কোনো ব্যাবস্থা নেয়া হবে কি না সে বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি এসপি স্যারকে জানানো হয়েছে, তিনি যেভাবে নির্দেশনা দেন সেভাবে বিষয়টা নিয়ে কাজ করা হবে। আর এই মামলার সাথে যাদের সম্পৃক্ততা নেই সঠিক তদন্ত ছাড়া তাদের কোনভাবেই হয়রানি করা হবে না বলেও জানান তিনি।
বা বু ম/ এস আর