নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরবর্তী সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে নব্য জেএমবির নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত করার দাবি করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। তবে আবারও সংগঠিত হয়ে হামলার পরিকল্পনা করছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনটি।
ইতোমধ্যে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) তথ্যের ভিত্তিতে সংগঠনটির আমির মাহাদী হাসান জন তুরস্কে গ্রেফতার হন। এরপর দেশে সংগঠনটির নেতৃত্বে আসেন মো. ইউসুফ ওরফে ইউসুফ হুজুর (৩৮)।
দীর্ঘ নজরদারির পর অবশেষে সহযোগী মো. জহিরুল ইসলাম ওরফে জহিরসহ (৪৩) ইউসুফকে গ্রেফতার করেছে সিটিটিসি।
রাজধানীর ডেমরা এলাকায় গোপন বৈঠকের তথ্য পেয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
এ সময় নব্য জেএমবির মুখপাত্র পত্রিকা নাবা, ১০টি ডেটোনেটর, বেশকিছু ডকুমেন্ট উদ্ধার করা হয়।
রোববার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি। আর সবচেয়ে কালো অধ্যায় হলি আর্টিজানসহ অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটনায় এই সংগঠন। এরপর ধারাবাহিক অভিযানে আমরা নব্য জেএমবির সব নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত করেছিলাম। আমাদের সাঁড়াশি অভিযানের পর নেতৃত্ব পর্যায়ের প্রায় সবাইকে গ্রেফতারের পর আমরা ভেবেছিলাম নব্য জেএমবি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। কিন্তু সংগঠনের পরবর্তী আমির মাহাদী হাসান জন বিদেশে বসে পুনরায় সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন।
সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, আমাদের তথ্যের ভিত্তিতে তুরস্ক পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তার অনুসারী কয়েকজনকে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা দেশে শনাক্ত করেছিলাম। আমাদের ধারাবাহিক তৎপরতায় গত অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসজুড়ে অন্তত ৭-৮ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। মাহাদীর বাংলাদেশের নেটওয়ার্কের বিষয়ে আমরা আগে থেকেই অবগত ছিলাম, এর ভিত্তিতেই তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাদের নেতা ইউসুফ। তিনি সংগঠনে ইউসুফ হুজুর নামেই পরিচিত ছিলেন। অবশেষে ইউসুফ ও তার সহযোগী জহিরুল ইসলাম জহিরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, আমরা যখনই ইউসুফের বিষয়ে তথ্য পাচ্ছিলাম, তখন খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে ইউসুফ ও আবু বকরকে একসঙ্গে ২০১৭ সালে গ্রেফতার করেছিল সিটিটিসি। সে সময় ইউসুফ হুজুর ছিলেন নেতা আর আবু বকর ছিলেন সংগঠনের অপারেশনাল কমান্ডার।
২০১৯ সালে জামিনে বেরিয়ে ইউসুফ সৌদি আরবে চলে যান। মাহাদী তুরস্কে অবস্থান করছিলেন। আগে থেকেই তার সঙ্গে ইউসুফের যোগাযোগ ছিল। মাহাদী বিদেশে বসে সংগঠনকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন। অনলাইনে এ দেশের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন ও নতুন সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন। তরুস্কে মাহাদীর গ্রেফতারের প্রক্রিয়াটি টের পেয়ে ২০২২ এর মাঝামাঝি সময়ে ইউসুফ দেশে ফিরে আসেন।
মাহাদী তুরস্কে গ্রেফতার হওয়ার পর ইউসুফ সংগঠনের দায়িত্ব নেন। এরপর ইউসুফের নেতৃত্বে অপারেশনাল পরিকল্পনা চলতে থাকে। নভেম্বরের ১১ তারিখে সংগঠনের অপারেশনাল কমান্ডার আবু বকরকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। পূজায় বড় হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। সে সময় আবু বকরের ডিভাইস থেকে এ ধরনের বিস্তারিত তথ্য পাই। আমরা বিষয়টি অবগত করার ভিত্তিতে দুর্গাপূজায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, আবু বকরের ডিভাইস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, পূজামণ্ডপে প্রয়োজনে গেরুয়া গায়ে দিয়ে হিন্দু সেজে গিয়ে রেকি করতে বলা হয়। তাদের যে নতুন পরিকল্পনা ছিল, তা আমাদের জন্য ছিল ভয়ের। তাদের ভাষায় ডিভাইস অর্থাৎ বিস্ফোরক ঢোলের ভেতরে করে মণ্ডপে নিয়ে যাওয়ার পরিরিকল্পনাও ছিল।
তার ডিভাইসে হামলার দিনক্ষণও জানিয়ে দিয়েছিল, আমাদের ব্যবস্থার কারণে সফল হয়নি। তাদের পরিকল্পনা আরও ছিল। পরশু দিন একত্রিত হয়েছিল। আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি, তাদের আর কী পরিকল্পনা ছিল জানার চেষ্টা করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইউসুফ নিজেই স্বচ্ছল, তার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ছিল। ২০১৭ সালে গ্রেফতারের আগে শিক্ষকতা করতেন। মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে বেশকিছু টাকা উপার্জন করেন। দেশে ফিরে বড় ব্যবসা শুরু করেন। লাভের টাকা পুরোটাই সংগঠনে বিনিয়োগ করতেন।
ইমাম মাহমুদের কাফেলা নামে যে জঙ্গি সংগঠনটি শনাক্ত করা হয়, তার প্রধান ইমাম যখন জেলখানায় ছিলেন তখন তার সঙ্গে জেএমবি সদস্যদের পরিচয় হয়। শারক্বিয়ার আদলে একটি সংগঠন তৈরি করার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু সংগঠিত হওয়ার আগেই তাদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, এ বছর অনেক শীর্ষ জঙ্গিদের গ্রেফতার করেছি। শারক্বিয়ার প্রধান শামিন মাহফুজকে গ্রেফতার করা হয়। শারক্বিয়ার সঙ্গে আনসার আল ইসলামের চুক্তি ছিল, বৈঠকে যারা ছিল তাদেরও শনাক্ত করে কয়েকজনে গ্রেফতার করেছি। আমাদের ইন্টেলিজেন্স অনেক সমৃদ্ধ, শনাক্ত করে সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।
থার্টিফার্স্টে হামলার কোনো পরিকল্পনা ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা এরকম কৃষ্টি কালচারে বিশ্বাস করে না। যখন অ্যাকটিভ ছিল তখন এ ধরনের অনুষ্ঠানে হামলার পরিকল্পনা করেছে। তাদের একটা পরিকল্পনা হয়তোবা ছিল। কারণ তাদের কাছ থেকে ডেটোনেটর উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে আজকের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। প্রত্যেক অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা মনে করি না হামলার কোনো হুমকি রয়েছে।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, নির্বাচন ঘিরে কোনো পরিকল্পনা ছিল কি না, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করব। পূজামণ্ডপে হামলার পরিকল্পনার তথ্য পেয়েছিলাম, সেজন্য জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করেছি। এমন কোনো পরিকল্পনা থাকলে জড়িতদের গ্রেফতার করব। তবে নির্বাচনে জঙ্গি হামলার কোনো আশঙ্কা নেই, আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি।
মাহাদীর তুরস্কে গ্রেফতারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নিজস্ব সূত্রে তাকে শনাক্ত করেছি, তার বাসার ঠিকানাসহ দিয়েছি। যে দোকানে বসে বাংলাদেশে যোগাযোগ করতেন সেই ছবিও আমরা দিয়েছি।