স্টাফ রিপোর্টার-
আর্থিক অনটন থেকে বাঁচতে মো. নওশাত বনে যান চম্পা ওরফে স্বপ্না হিজড়া। আর তাকে হিজরা হতে ইন্ধন দেন দেলু হিজরা নামক এক ব্যক্তি। বাস্তব জীবনে চম্পা ওরফে নওশাতের ১২ বছরের এক ছেলে রয়েছে । ঠিক ১১ বছর আগে স্ত্রীর মৃত্যুর পর আর্থিক অনটনে জীবন কাটছিল তার। দেলু হিজড়া নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে তার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নিজেকে পরিবর্তন করে চম্পা ওরফে স্বপ্না হিজড়া বনে যায় সে। টাকা উপার্যনের উদ্দেশ্য ঢাকার আশুলিয়ায় এসে প্রেমের সম্পর্ক গড়েন রাকিব হাসান শাওন(৩৫) নামের এক ব্যক্তির সাথে। আশুলিয়া থানার এনায়েতপুরের একটি ভাড়া বাসায় স্বামী স্ত্রী হিসেবেই থাকতেন তারা।

অন্য এক নারী হিজড়ার সাথে রাকিবের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে বিরোধ শুরু হয়। এরই জেরে ২০২১ সালের ১ জুন রাকিবকে গলায় গামছা পেচিয়ে খুন করেন স্বপ্না।
ঘটনার দুই বছর পর গত ১৭ অক্টোবর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানা এলাকার হিজড়া পল্লি থেকে স্বপ্নাকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই । ঢাকা জেলা পিবিআইয়ের একটি চৌকস দল তাকে গ্রেফতার করে।
তাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা জেলার উপ পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন। বিজ্ঞ আদালত থেকে রিমান্ড প্রাপ্ত হয়ে তিন দিনের রিমান্ডে বেরিয়ে আসে লিঙ্গ পরিবর্তনকারী এক হিজড়া চক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য।

লিঙ্গ পরিবর্তনের ঘটনায় হিজড়াকেও গত ২৩ অক্টোবর জামালপুরের নারায়ণপুর থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই। পরে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চায় পিবিআই।
বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) বেলা ১২ টায় রাজধানীর ধানমন্ডি পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের ৭ জুন আশুলিয়া থানার এনায়েতপুর গ্রামে ফাঁকা জমিতে বস্তাবন্দি অজ্ঞাতনামা পুরষ (৩৫) এর অর্ধগলিত একটি লাশ পাওয়া যায়। পরদিন একটি হত্যা মামলা হয় এবং থানা পুলিশ মামলাটি দুই মাস তদন্ত করে কোনো রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় মামলাটির তদন্ত করে পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশ। তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. আনোয়ার হোসেন ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী ৫ম তলা একটি ভবনের মালিকের কাছ থেকে জানতে পারেন লাশ পাওয়ার পরের দিন তার বাসার নিচতলার ভাড়াটিয়া চম্পা নামের এক তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি তার বাবার অসুস্থ্যতার কথা বলে তার গ্রামের বাড়ী জামালপুরের নারায়ণপুর যান।
ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা জানতে পারেন, উক্ত ঠিকানায় চম্পা হিজড়া নামের একজনের বাড়ী আছে যার পূর্বের নাম নওশাদ। প্রায় ২০ বছর আগে নওশাদের পিতা-মাতা মারা গেছেন এবং সে ঢাকায় বসবাস করে। মাঝে মধ্যে গ্রামে যান। পিতা-মাতা না থাকা স্বত্ত্বেও লাশ পাওয়ার পরের দিন পিতার অসুস্থতার কথা বলে নওশাদ ওরফে চম্পা হিজড়া বাসা ত্যাগ করে গ্রামে চলে যাওয়ায় সন্দেহ হয়। পরে খোঁজাখুজির এক পর্যায়ে বরগুনার বামনা থানার ভাইজোড়ার মো. রাকিব হাসান শাওন নামে একটি ঠিকানা পাওয়া যায়।
তার পিতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার ছেলে রাকিব ঢাকার আশুলিয়ায় এক হিজড়ার সাথে বসবাস করে। কিন্তু কোথায় থাকে সেই ঠিকানা তিনি বা পরিবারের কেউ জানেন না। রাকিব হাসান শাওনের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত একটি মোবাইল নম্বর চিনতে পারলেও ছেলের লাশ সনাক্ত করতে পারেননি। পরে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে ছেলের লাশ নিশ্চিত হয় পুলিশ।
বনজ কুমার বলেন, পিবিআই ঢাকা জেলা তদন্ত টিম ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে নওশাদ ওরফে চম্পা হিজড়াকে গ্রেফতারের জন্য তার গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালায়। এরপর জামালপুর, শেরপুর বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর সহ গাইবান্ধা জেলার হিজড়া পল্লিতে অভিযান চলে। এদিকে, নওশাদ ওরফে চম্পা হিজড়া তার নাম পরিবর্তন করে স্বপ্না হিজড়া নামে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানা এলকার হিজড়া পল্লিতে আত্নগোপণ করে। গত ১৭ অক্টোবর এই হিজড়া পল্লিতে অভিযান তাকে গ্রেফতার করে পিবিআই।
পিবিআই প্রধান বলেন, গ্রেফতারের পর রিমান্ডে বেরিয়ে আসে ঘটনার আসল রহস্য। আসামী নওশাদ ওরফে চম্পা ওরফে স্বপ্না জানায়, সে জন্মগত ভাবে হিজড়া ছিল না। সে বিবাহিত পুরুষ এবং নাম ছিল নওশাদ। তার ১২ বছর বয়সী আকাশ নামের একজন পুত্র সন্তান আছে। প্রায় ১১ বছর আগে তার স্ত্রী মারা যায়। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সে কর্মবিমুখ হয়ে বেকার জীবন যাপন করতে থাকে এবং হতাশ হয়ে পড়ে। স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছু দিন পর তার সাথে দেলু হিজড়ার পরিচয় হয়। দেলু হিজড়া নওশাদকে হিজড়া হওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং বলে হিজড়া হলে সে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারবে। দেলু হিজড়ার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নওশাদ হিজড়াদের দলে যোগ দেয়। এর দেড় বছর পর দেলু হিজড়ার কথামত খুলনার লোহাপাড়ায় একজন ডাক্তারের মাধ্যমে অপারেশন করে মেয়ে হিজড়া হয়। হিজড়া হওয়ার পরে নওশাদ তার নাম পরিবর্তন করে চম্পা নাম ধারণ করে দেলু হিজড়ার অধীনে ৪-৫ বছর কাজ করে। পরে ঢাকার আশুলিয়ার এনায়েতপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করে। সেখানে রাকিব হাসান শাওন এর সাথে তার পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা একসাথে ভাড়া বাসায় বসবাস করতে শুরু করে। তার খরচ চম্পা বহন করতো।
তিনি বলেন, ২০২১ সালে ১লা জুন ঘটনার দিন রাকিব চম্পার কাছে এক হাজার টাকা চায়। টাকা না দেওয়ায় রাকিব তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। পরে তার কাছে ২০ টাকা চাইলে রাকিব ২০ টাকা দিয়ে ২টা মাইলাম ট্যাবলেট কিনে খায়। মাইলাম ট্যাবলেট কিনতে যাওয়ার সময় রাকিব তার মোবাইল ফোনটি বাসায় রেখে যায়। এ সময় রাকিবের মোবাইলে রিপা নামের একজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি ফোন করে। নওশাদ ওরফে চম্পা ফোনটি রিসিভ করে জানতে পারে, রিপার সাথেও রাকিবের প্রেমের সম্পর্ক সহ শারিরীক সম্পর্ক রয়েছে। রাকিব বাসায় ফিরে আসলে নওশাদ ওরফে চম্পা রাকিবের কাছে রিপার বিষয়ে জানতে চায়। এই নিয়ে তাদের মধ্যে বাতবিতন্ডা হলে চম্পা রাকিবের গলায় গামছা পেচিঁয়ে তাকে হত্যা করে।
তিনি বলেন, হত্যার পর আসামী নওশাদ তার গুরুমা রুমি হিজড়ার বাসা থেকে চটের বস্তা নিয়ে এসে রাকিবের লাশটি ভরে পাশের রুমে রেখে গুম করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে তার জন্য সে দিনের বেলা তার কাজকর্ম শেষ করে বাসায় ফিরে এসে রাত্রী যাপন করতো। ৫ দিন পর ৭ জুন প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে সন্ধার পরে এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় সে বস্তায় ভরে রাখা ভিকটিমের লাশটি নিয়ে এসে রাতের অন্ধকারে বাসার পাশে ঝোপের মধ্যে ফেলে রেখে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকে। পরের দিন অর্থাৎ ৮ জুন সকালে স্থানীয় লোকজন বস্তাবন্দি লাশ দেখতে পেয়ে থানা পুলিশকে খবর দিলে নওশাদ ওরফে চম্পা ওরফে স্বপ্না পালিয়ে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানা এলকার হিজড়া পল্লিতে গিয়ে নাম পরিবর্তন করে স্বপ্না হিজড়া নামে আত্নগোপণ করে।