কুবি প্রতিনিধি:
শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ব্যাপারে অশালীন মন্তব্য ও দুর্ব্যবহার করা, বিএনপি-জামায়াতপন্থী কর্মকর্তাদের বেশি সুবিধা অপরদিকে আওয়ামীপন্থীদের অবহেলা ও বঞ্চিত করা, পদের ক্ষমতাবলে নিজ গ্রুপের শিক্ষকদেরকে নানা অবৈধ সুবিধা দেয়া, অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষকদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি দিয়ে ঢাকায় যাতায়াত করা ও বেশিরভাগ ঢাকায় থাকাসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মো. আবু তাহেরের বিরুদ্ধে।
তবে দিনের পর দিন এভাবে অভিযোগের পাহাড় জমলেও তার বিরুদ্ধে হয়নি কোনো তদন্ত, নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা।
পদোন্নতিতে পক্ষপাতিত্ব: বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থনীতি, ইংরেজি ও অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের শিক্ষক ড. স্বপন চন্দ্র মজুমদার, ড. বনানী বিশ্বাস ও ড. মিজানুর রহমান আবেদনের ছয় মাস পরে পদোন্নতি পান। নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আইনুল হক পদোন্নতি পেয়েছেন আবেদনের তিন মাস পর। তাদের অভিযোগ রেজিস্ট্রার তার পক্ষের শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার জন্য তাদের পদোন্নতি বোর্ড দেরি করে ডেকেছেন।
অন্যদিকে পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার তিন দিনের মাথায় অনিয়ম করে গত বছরের ২১ শে ফেব্রুয়ারির দিন (জাতীয় ছুটি) প্ল্যানিং করে শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ড. শামিমুল ইসলামের স্ত্রী অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রাফিয়া ইসলাম লিনা এবং লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক রুহুল আমিনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তারা দু্জনেই রেজিস্ট্রারের পক্ষের শিক্ষক তাই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পদোন্নতি পায় বলে অভিযোগ উঠে।
অথচ অন্য গ্রুপের শিক্ষক হওয়ায় দেশের বাহিরে থেকে করা পিএইচডির সত্যতা যাচাই করতে একাধিকবার বাহিরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেইল করে বিব্রত করার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু নিজ গ্রুপের শিক্ষক হলে তড়িঘড়ি করে পদোন্নতি দেয়া হয়, প্রয়োজন পরে না যাচাই-বাচাইয়ের।
রেজিস্ট্রারের অনুপস্থিতি: রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মো. আবু তাহের সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে গড়ে দুই-তিনদিন করে উপস্থিত থাকেন বলে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের অভিযোগ। রেজিস্ট্রারের বাসা ঢাকায় এবং তার পরিবার সেখানেই থাকে। প্রশাসনিক সকল কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের রেজিস্ট্রার অফিসের উপর নির্ভর করতে হয়। তার অনুপস্থিতির কারণে শিক্ষাছুটিসহ বিভিন্ন ধরনের ছুটি, অনাপত্তিপত্র কিংবা যেকোনো ধরনের অনুমতির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরীজীবীরা দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ। তবে গত ৩১ জানুয়ারি নতুন উপাচার্য আসায় রেজিস্ট্রারকে আগের তুলনায় অফিসে বেশি আসতে দেখা যাচ্ছে বলে জানা যায়। তার অনুপস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কেউ কেউ তাঁকে আড়ালে ‘কুবির কলিমুল্লাহ’ বলে ডাকেন।
গতসপ্তাহে দেখা যায়, সোমবার ও মঙ্গলবার দুইদিন তিনি ছুটি কাটানোর পর বুধবার দুপুরের পরে তিনি অফিসে আসেন। অথচ করোনার জন্য অফিস টাইম শেষ হয়ে যায় দুপুর ২ টায়। তাই অফিস টাইম শেষ হয়ে যাওয়ার পর জমে থাকা ফাইলপত্র স্বাক্ষর করে উপাচার্যের কাছে নিয়ে যান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নিয়ে ঢাকা যাতায়াত: রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদানের পর থেকেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রাইভেট কার ব্যবহার করছেন। তিনি তার ঢাকার বাসায় যাওয়া-আসার জন্য নিয়মিত এ গাড়িটিই ব্যবহার করেন। অথচ বিশ্ববিদ্যায়ের আইনে সুস্পষ্টকরে বলা আছে, রেজিস্ট্রার হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বক্ষণিক আবাসিক কর্মকর্তা। কিন্তু এ আইনটি তিনি অমান্য করেই চলছেন।
সার্বক্ষণিক আবাসিক কর্মকর্তা হিসেবে থাকার কথা থাকলেও ঢাকা থাকার বিষয়ে রেজিস্ট্রার বলেন, আমি ঢাকা থাকি সেটা জেনেই আমাকে আগের উপাচার্য স্যার নিয়োগ দিয়েছিলেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নিয়ে ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে রেজিস্ট্রার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গনোগ্রামে তো রেজিস্ট্রার পদের জন্য গাড়ি দেয়াই আছে। আর আগের রেজিস্ট্রাররা কি গাড়ি ব্যবহার করেনি?
ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নিয়ে আসা যাওয়ার ব্যাপারে তিনি আরো বলেন, আগের উপাচার্য আমাকে অনুমতি দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নিয়ে ঢাকায় আসা-যাওয়া করার জন্য। তখন আমি করেছি। বর্তমান উপাচার্য যদি না দেয় তো নিব না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, উনাকে গাড়ি দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কর্মকর্তা হিসেবে। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি দিয়ে ঢাকা আসা-যাওয়া করেছেন এ বিষয়ে উপাচার্য মহোদয়কে (সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপন ড. এমরান কবির চৌধুরী) বারবার অবহিত করেছি, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেননি।
রেজিস্ট্রার অফিস যেনো গ্রুপের কার্যালয়: রেজিস্ট্রার ড. তাহের যে কয়দিন অফিস করেন সে কয়দিন তার পক্ষের শিক্ষকেরা তার অফিসে গিয়ে বসে থাকেন। ওই কয়দিন তার কার্যালয়কে তার পক্ষের লোকদের দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করা হয় বলে অভিযোগ উঠে। সন্ধ্যার পরও তার পক্ষের শিক্ষকদের সাথে অফিসে মিটিং করেন বলে জানা যায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা তার কার্যালয়ে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।
অফিস সময়ের অনেক পরেও রেজিস্ট্রার দপ্তরে কখনো তার পক্ষের শিক্ষক নেতা, কখনো ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ে মিটিং করেন। এ ব্যাপারে রেজিস্ট্রার বলেন, অনেক সময় কাজ শেষ করতে দেরি হয়। তখন যদি কেউ সমস্যা নিয়ে আসে তখন তো কথা বলতেই হয়।
চার শিক্ষককে চোর সম্বোধন: রেজিস্ট্রার ড. আবু তাহেরের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষকে ‘চোর’ বলে সম্বোধন করার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি চার শিক্ষক ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. এমদাদুল হক, লোক প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জিয়া উদ্দিন, রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে তদন্তের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
শিক্ষকদেরকে নিয়ে এমন মন্তব্য করার প্রসঙ্গে রেজিস্ট্রার বলেন, আমি কোন প্রসঙ্গে কার সাথে কি বলেছি সেটা আমি বলতে পারবো না। আর আদৌ বলেছি কি না সেটা আমার মনে পড়ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবির বলেন, রেজিস্ট্রারের ব্যাপারে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন করেছে। তারাও অনেক অভিযোগ তুলেছে। এখন রেজিস্ট্রারের বিষয়ে যদি কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার থাকে সেটা উপাচার্য স্যার নিবেন। তবে উপাচার্য স্যার যেহেতু নতুন আসছে তাই উনাকে একটু সময় দেয়া দরকার।
উল্লেখ্য, গত মাসের ১৯ জানুয়ারি ড. আবু তাহেরের বিরুদ্ধে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা, বিএনপি-জামাতপন্থীদের সুবিধা প্রদান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ কার্যক্রমে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ তুলে রেজিস্ট্রারের অপসারণ চেয়ে রেজিস্ট্রার দপ্তরে তালা দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তালা দেয়ার ৫ দিন পর ২৪ জানুয়ারি উপ-উপাচার্যের আশ্বাসে রেজিস্টারের অপসারণের দাবিতে তালা খুলে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২ দিনের আল্টিমেডাম দেন তারা। ৬ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আব্দুল মঈন কাছে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গেলে তাদের কাছে উপাচার্য কয়েকদিন সময় চাইলে তারা উপাচার্যকে কয়েকদিন সময় দেয়ার কথা জানান।