বিল্লাল হোসেন,যশোর প্রতিনিধি:
কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাসে বিধবস্ত যশোর। কোনভাবেই সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের রেডজোন ও ইয়োলোজোনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের ৩ জন করোনায় আক্রান্ত ও ৯ জন উপসর্গ নিয়ে মারা যান। এছাড়া শহরের বেজপাড়া এলাকার করোনাক্রান্ত যুবকের খুলনার হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে করোনায় প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১শ’ ৬০ জনে। শুধু মাত্র জুন মাসে মারা গেছেন ৭৭ জন। এদিকে, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের করোনা ইউনিটে রোগীর স্বজনেরা অবাধে যাতায়াত করায় সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। আবার হোম আইসোলেশনে থাকা করোনা রোগী বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি করছেন।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আরিফ আহমেদ জানান,গত ২৪ ঘন্টায় করোনায় আক্রান্ত অবস্থায় রেডজোনে ৩ জন নারী পুরুষ মারা গেছেন। তারা হলেন, যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটির ছাতিয়ানতলা গ্রামের গোলাম বিশ্বাসের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের বিশ্বাস (৬০), ঝিকরগাছা উপজেলার মাটিকুমড়া গ্রামের আলতাফ হোসেনের স্ত্রী সালেহা বেগম (৭২) ও মেহেরপুরের চুয়াডাঙ্গা উপজেলার হাবিবপুর গ্রামের আব্দুস সালামের স্ত্রী নাছিমা বেগম (৪০)। এছাড়া ইয়োলোজোনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ জনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন, যশোর শহরের পুরাতন কসবা এলাকার মোস্তাহিদ বিল্লাহর স্ত্রী সেলিনা খাতুন (৪৫), শংকরপুর এলাকার নজরুল ইসলামের স্ত্রী পাপিয়া খাতুন (৩৫), উপশহর এলাকার মকবুল ইসলামের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৪৫), সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি গ্রামের মিলন হোসেনের মেয়ে মিম (১৮), ঝুমঝুমপুরের বেলায়েত হোসেনের স্ত্রী বিউটি খাতুন (৫৬), মণিরামপুর উপজেলার হানুয়ার গ্রামের আব্দুস সালামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৬৫), এলাঞ্চি গ্রামের ইজাহার আলীর ছেলে মোকলেছুর রহমান (৪৮), বাঘারপাড়া উপজেলার পাঠান পাইকপাড়ার লাল মিয়ার ছেলে শেখ বদর উদ্দিন (৫৭) ও চৌগাছা উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের এনায়েত উল্লাহর ছেলে দাউদ হোসেন ((৬৫)। সিভিল সার্জন অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা ডা. রেহেনেওয়াজ জানান, যশোর ২৮০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ৩ জন ছাড়াও যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকার রাসেল (৩২) নামে এক যুবক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। খুলনার গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ডা. রেহেনেওয়াজ আরও জানান, বুধবার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জেনোম সেন্টারে ৫০৫ টি নমুনায় ২০৫ জন ও খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) ল্যাবে ৬ টি নুমনা পরীক্ষায় ১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল কেন্দ্রে ৪১ জনের র্যাপিড এন্টিজেন পরীক্ষায় ২১ ও বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০০ জনে ৬৩ জনের পজেটিভ শনাক্ত হয়। এছাড়া জিন এক্সপার্ট মেশিনে ১৮ টি নমুনা পরীক্ষায় ১০ জনের শরীরে করোনার জীবাণু মেলে। সব মিলিয়ে ৭৭০ জনের টি পরীক্ষায় ৩০০ জনের করোনা পজেটিভ ও ৪৭০ জনের নেগেটিভ শনাক্ত হয়। শনাক্তদের মধ্যে সদর উপজেলায় ২২১ জন, কেশবপুর উপজেলায় ১০ জন, ঝিকরগাছা উপজেলায় ১৮ জন, অভয়নগর উপজেলায় ৯ জন, মণিরামপুর উপজেলায় ১৮ জন, বাঘারপাড়া উপজেলায় ৮ জন ,শার্শা উপজেলায় ৮ জন ও চৌগাছা উপজেলায় ৮ জন রয়েছেন। যবিপ্রবির অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও পরীক্ষণ দলের সদস্য অধ্যাপক ড. ইকবাল কবীর জাহিদ জানান, মঙ্গলবার রাতে শুধুমাত্র যশোর জেলার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অন্য কোন জেলার নমুনাপরীক্ষা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর সদর উপজেলার চান্দুটিয়া গ্রামের আজিজুল ইসলাম নামে একজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি হোম আইসোলেশনে না থেকে বাড়ির বাইরে প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি করছেন। দেয়াড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান তার বাড়ি লকডাউন করে আইসোলেশন সঠিকভাবে মেনে চলার পরামর্শ দিলেও তা মানছেন না। এদিকে, সরেজমিনে দেখা গেছে, নিয়মনীতি মেনে না চলার কারণে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল থেকে করোনার সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। নমুনা সংগ্রহের স্থানে সন্দিগ্ধদের ঠাসাঠাসি, রেজিস্ট্রেশনের জায়গায় জটলা করা ও করোনা ওয়ার্ডে অবাধ যাতায়াতের কারণে এই আশঙ্কা। এটা মানুষের অসচেতনতা বলে জানিয়েছেন, হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আরিফ আহমেদ জানান, নিজেরা সচেতন না হলে কিছু করার নেই। রোগীর স্বজনদের করোনা রেডজোন ও আইসিইউতে ঢোকার অনুমতি নেই। যশোর সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন জানান, ৩০ পর্যন্ত যশোর জেলায় ১২ হাজার ৪শ’ ৫৯ জন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন ৭ হাজার ৪শ ৬৯ জন। বর্তমানে ৯৯ জন করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ও ৪ হাজার ৭শ’ ৪৫ জন নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যশোরের বিভিন্ন হাসপাতাল ও বাড়িতে মৃত্যু হয়েছে ১৪৬ জনের। এছাড়া ঢাকায় ৬ জন খুলনায় ৭ জন ও সাতক্ষীরার হাসপাতালে মারা গেছেন ১জন। যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের রেডজোনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত ৩ জনের হিসাব এখনো তার কাছে দেয়া হয়নি। সিভিল সার্জন আরও জানান, জেলায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বাড়ছে। এক প্রশ্নে সিভিল সার্জন জানান, হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে রোগীর স্বজনরা ইচ্ছামতো যাতায়াত করে থাকলে সেটা দুঃখজনক। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হবে। এমনিতেই করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। করোনা ওয়ার্ডে স্বজনরা অবাধে যাতায়াত করলে আরও সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি না করে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সঠিকভাবে হোম আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সিভিল সার্জন। যশোরের জেলা প্রশাসক শেখ তমিজুল ইসলাম জানান, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। জনসাধারণের সচেতনতার অভাব, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনার প্রতি অনীহা, আক্রান্তদের থেকে স্বজনদের সঙ্গরোধ না-করার কারণেই প্রতিদিন আক্রান্তের রেকর্ড ভাঙছে। লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি মানলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
উল্লেখ্য, গত মে মাসের শেষের দিকে জেলায় গড় আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো শতকরা ২২ ভাগ। আর জুন মাসে গড় আক্রান্তের হার ৫০ শতাংশ পার হয়েছে। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৯ জুন দিবাগত রাত থেকে যশোর ও নওয়াপাড়া পৌরসভার সকল ওয়ার্ডে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ তমিজুল ইসলাম। এরমধ্যে করোনা পরিস্থিতি প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙছে। এরপর গত ১৫ জুন জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির দ্বিতীয় সভায় বিধিনিষেধ বাড়িয়ে যুক্ত করা হয় ঝিকরগাছা পৌরসভা, সদরের উপশহর, নওয়াপাড়া, আরবপুর, চাঁচড়া, শার্শা ইউনিয়ন ও বেনাপোল বাজার। পরে যশোর জেলায় লকডাউন আরোপ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।