আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ধারণার চেয়ে অকল্পনীয় দ্রুতগতিতে ধ্বংস হচ্ছে পৃথিবীর রেইনফরেস্ট বা বৃষ্টিবহুল বনাঞ্চল। ২০২২ সালে প্রতি ৫ সেকেন্ডে একটি ফুটবল মাঠের সমান আয়তনের বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক অলাভজনক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের (ডব্লিউআরআই) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের পুরো বছরজুড়ে বিশ্বে ধ্বংস হয়েছে ৪১ হাজার বর্গকিলোমিটারের সমপরিমাণ বনাঞ্চল। ধ্বংস হওয়া বনাঞ্চলের আয়তনের নিরিখে বলা যায়, ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডসের যে আয়তন— তার সমপরিমাণ বন ধ্বংস হয়েছে গত বছর।
গড় হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, গত বছর প্রতি ৫ সেকেন্ডে ধ্বংস হয়েছে একটি ফুটবল মাঠের সমান বনাঞ্চল।
আর এই বিপুল পরিমাণ বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে পৃথিবীর বাতাসে নির্গত হয়েছে ২৭০ কোটি টন কার্বন। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দূষিত বাতাসের দেশ ভারতে এক বছরে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসৃত হয়, তার সমপরিমাণ কার্বন বিশ্বের বাতাসে নির্গত হয়েছে কেবলমাত্র বনাঞ্চল উজাড় ফলে।
গত বছর বিশ্বজুড়েই বৃষ্টিবহুল বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে তবে বিশ্বের দেশগুলোতে এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ ব্রাজিল। উজাড় হওয়া ৪১ হাজার কিলোমিটার রেইনফরেস্টের ৪৩ শতাংশই ব্রাজিলের আমাজন বনাঞ্চল।
এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মধ্য আফ্রিকার দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো। গত বছর উজাড় হওয়া বনাঞ্চলের ১৩ শতাংশ ঘটেছে এই দেশটিতে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার অপর দেশ বলিভিয়া। গত বছর ধ্বংস হওয়া মোট বনাঞ্চলের ৯ শতাংশ ছিল এই দেশটির।
৯ হাজার কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে আমাজন
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন রেইনফরেস্ট বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৃষ্টিবহুল অরণ্য। এই অরণ্যের বড় অংশই পড়েছে ব্রাজিলে। কিছু অংশ আর্জেন্টিনা, পেরু ও বলিভিয়াতেও পড়েছে। ৬৭ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বিশাল বনাঞ্চল প্রতি বছর বাতাস থেকে ৯ হাজার কোটি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে।
গত কয়েক দশক ধরেই আমাজনের বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছিল, তবে তা সর্বোচ্চ গতি পায় দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর সময়। বলসোনারোর নেতৃত্বাধীন সরকারের বনাঞ্চল রক্ষা সম্পর্কিত শিথিল নীতির সুযোগ নিয়ে চোরাই কাঠ ব্যবসায়ীরা রীতিমতো উজাড় করে দেন এই বনাঞ্চলের বিরাট অংশ।
বিশ্বের ১৬০ কোটি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য সরাসরি আমাজনের জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল; এবং তাদের অর্ধেকই বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। যদি এই বন ধ্বংস বন্ধ না করা যায়, সেক্ষেত্রে এইসব লোকজনের জীবন-জীবিকাও হুমকির মুখে পড়বে।
আশার কথা হলো— চলতি বছর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া লুইজ ইনাকিও লুলা দা সিলভা জানিয়েছেন, বন উজাড় হওয়া বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন তিনি।
কোকোয়ার চাষ, স্বর্ণের অনুসন্ধান ও কাঠকয়লার ব্যাপক উৎপাদনকে ডিআর বনাঞ্চল ধ্বংসের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ডব্লিউআরআইয়ের প্রতিবেদনে।
২০২১ সালে বনাঞ্চল ধংস রোধ করার জন্য ৫০ কোটি ডলারের বিনিময়ে জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তি করেছিল ডিআর কঙ্গো; কিন্তু গত বছর তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বিপুল পরিমাণ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে দেশটিতে। কঙ্গোতে এখনও ৮০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পরিষেবার সুবিধাবঞ্চিত।
মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউআরআইয়ের বৈশ্বিক বনাঞ্চল বিভাগের পরিচালক মিকেইলা ওয়েইসা বলেন, ‘এই শতকের শুরু থেকে বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চলগুলোর ধ্বংসের হার মারাত্মকভাবে বেড়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর নানা নীতি নেওয়া সত্ত্বেও এই ধ্বংসযজ্ঞ থামানো যাচ্ছে না।’
‘জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে এখন চারদিকে কথা হচ্ছে। যদি আমরা বনাঞ্চল উজাড় হওয়া ঠেকাতে না পারি, সেক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ, জীববৈচিত্র রক্ষা, কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তা— সবকিছু বিপন্ন হবে,’ সংবাদ সম্মেলনে বলেন মিকেইলা ওয়েইসা।