পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য মিয়ানমারের ক্ষমতাশীল দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিশ্চিত করেছে। শুক্রবার নির্বাচনের সর্বশেষ ফলাফলে এ তথ্য জানা যায়।
সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ৩২২ আসন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এনএলডি নিশ্চিত করেছে ৩৪৬ আসন।
প্রাথমিক ফলাফলের ভিত্তিতে অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন দল বিজয় দাবি করেছে ভোটের দিন। কয়েক দিন পর নতুন ফলাফল প্রকাশ হলো।
তবে সেনাসমর্থিত বিরোধীরা পুনরায় নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে।
ভারত, জাপান, সিঙ্গাপুর এর মধ্যেই জয়ী হওয়ায় এনএলডিকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এনএলডির মুখপাত্র মনয়ওয়া অং শিন বলেন, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয় প্রমাণ করে জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। তবে আমাদের কার্যকরী জাতীয় ঐক্যের একটি সরকার গঠন করতে হবে।
এনএলডি ঘোষণা দিয়েছে, সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য তারা সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীগুলোকে আমন্ত্রণ জানাবে। ২০১৫ সালে দলটি ক্ষমতায় এলেও এমন ঘোষণা এটাই প্রথম।
রোহিঙ্গা সংকট তৈরির পর এবারের নির্বাচনকে এনএলডি এবং অং সান সিু চির জনপ্রিয়তার নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
রোহিঙ্গা সংকটে সু চির সম্পৃক্ততার পরও মিয়ানমারে তার জনপ্রিয়তা অব্যাহত থাকলেও, বিশ্বব্যাপী তীব্র সমালোচিত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এ নেত্রী।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে ১০ লাখের বেশি মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২০১৭ সালের এ বর্বরতাকে জাতিগত নিধন আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দাবি করেছে তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে। সু চি সেনাবাহিনীর এ দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়ে সাফাই গেয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পর্যবেক্ষকরা।
ফলাফল নিয়ে বিতর্ক কি?
রোববার নির্বাচনে ভোট দেন মিয়ানমারের ভোটাররা। ভোট গণনা চলমান থাকায় নির্বাচন কর্মকর্তারা এখনো ফলাফল ঘোষণা করেননি। ৪১৬টি আসনের মধ্যে ৬৪টি আসনের ফলাফল এখনো ঘোষণা বাকি।
রোববার ভোটগ্রহণের কিছুক্ষণ পরই এনএলডি দাবি করে পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আসনের চেয়ে বেশি আসন পাবে তারা।
কিন্তু মিয়ানমারের শক্তিশালী সেনাবাহিনী সমর্থিত বিরোধীদল সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। তবে অভিযোগের পক্ষে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ তারা উপত্থাপন করেনি।
বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) জানায়, তারা এ ফলাফল মেনে নেবে না। স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং মিথ্যা প্রচারণামুক্ত নির্বাচন আয়োজনে কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানান তারা।
ভোটের আগে সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, ভোটার তালিকায় অনেক ভুল রয়েছে। তালিকা তৈরিতে নিয়মনীতি ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন হয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।
সেনাবাহিনী তাদের দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করেনি। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, নির্বিঘ্নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
দেশটির ইউনিয়ন ইলেকশন কমিশন (ইউইসি) জানায়, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর চেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচন হতে পারে না বলেও দাবি তাদের।
এর আগে ইউইসির বরাতে মিয়ানমার টাইমস জানায়, ফলাফল চূড়ান্ত। পুনরায় নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই।
ইউইসির মুখপাত্র ইউ মিয়াং নাইং বলেন, ইউএসডিপির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। কিছু লোক নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ করছে বলেও জানান তিনি।
নির্বাচন কি বিতর্কিত ছিল?
রোহিঙ্গাদের ভোট দেয়া থেকে বঞ্চিত করায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্র্রশ্ন তুলেছেন পর্যবেক্ষকরা।
চলতি বছরের শুরুতে অন্তত ১২ জন রোহিঙ্গা প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আবেদন জানায়। তাদের মধ্যে ৬ জনকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হয়নি।
অন্যান্য সংখ্যালঘুরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছে।
সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যকার সংঘাতের কারণে অক্টোবরে রাখাইনের বড় অংশে ভোটগ্রহণ বাতিলের ঘোষণ দেয় দেশটির নির্বাচন কমিশন। দু’পক্ষের সংঘাতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। বাস্তুচ্যুত হয় লাখ লাখ মানুষ।
সংঘাতকবলিত শান এবং কাচিন রাজ্যেও আংশিকভাবে নির্বাচন বাতিল করা হয়। কমিশনের দাবি ওই সব এলাকায় স্বচ্ছ, স্বাধীন নির্বাচন আয়োজন সম্ভব না।
ভোটগ্রহণ বাতিল করায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। ৩৭ লাখ নিবন্ধিত সংখ্যালঘু ভোটারের মধ্যে ২০ লাখকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা হয়।
মিয়ানমারের নির্বাচন পদ্ধতি কি?
মিয়ানমার ফার্স্ট-পাস্ট-দি-পোস্ট সিস্টেম অনুসরণ করে। এ প্রক্রিয়ায় একজন ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। যে প্রার্থী সর্বোচ্চ ভোট পায় তিনি বিজয়ী হন।
ইউএসভিত্তিক কার্টার সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ৯২টি রাজনৈতিক দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ৬ হাজার ৯০০ প্রার্থী এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
মোট আসনের একটা অংশ সামরিক বাহিনীর জন্য নির্ধরাণ করা আছে। সংবিধান অুনযায়ী স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্তসংক্রান্ত মন্ত্রণালয় দেখভালের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে। ২০০৮ সালের বিতর্কিত সংশোধনের মাধ্যমে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।