অবশেষে ফেসবুকের সর্ববৃহৎ বাংলা বইয়ের বিষয়ের উপর তৈরী ফেসবুক গ্রুপ “মলাট”-কে আইনি নোটিশ পাঠালেন ‘মিত্র এন্ড ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেডের’ পক্ষে ইন্দ্রাণী রায় মিত্র। যা নিয়ে এ এমুহূর্তে সোশাল মিডিয়া সরগরম।
যে ফেসবুক গ্রুপকে নিয়ে এত কাণ্ড সেই মলাট ফেসবুক গ্রুপের সদস্য / সদস্যা সংখ্যা এ এমুহূর্তে প্রায় ৬৫০০০ হাজারের বেশী। প্রকাশকের পক্ষে পাঠানো নোটিশে নাকি প্রায় মোট ৬৫০০০ সদস্য / সদস্যাকেও ওই নোটিশের অন্তর্ভুক্তি করা হয়েছে।
সোশাল মিডিয়ায় ‘পিডিএফ’ বনাম ‘বাংলা ছাপা বই’ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুকে তীব্র বিতর্ক চলছিল। কিন্তু সেই বিতর্ক ফেসবুক ছেড়ে আইনত লড়াইতে পরিণত হয়েছে তা জানতে পেরে পাঠক / পাঠিকারা চরম বিস্মিত। কারণ অনেকের মতে মলাট গ্রুপ আছে বলে অনেক দুস্প্রাপ্য বা হারিয়ে যাওয়া বই বা প্রচুর প্রচুর অতি প্রাচীন বই পাওয়া যায়। যার ফলে পাঠক / পাঠিকা থেকে লেখক / লেখিকা, এমন কি সাহিত্য গবেষকরা সহ সকলেই ব্যাপকভাবে উপকৃত হন।
কলেজস্ট্রীটের এক বুক সেলার এবং বইয়ের সমালোচক সুশোভন রায় জানান “পিডিএফ পড়বার পর, ভাল লাগার পর অনেক মানুষ সেই বইয়ের ছাপা বই কিনেছেন এমন উদাহরণ অনেক অনেক আছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল বাংলাদেশী লেখক মোঃ নাজিমুদ্দিন এর রবীন্দ্রনাথ সিরিজের বই। যেটা নিয়ে প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক সৃজিত মুখার্জী ওয়েব সিরিজ করতে চলেছেন বলে খবর। আমি নিজেও থ্রিলার পাঠক। এমন কত উদাহরণ আছে সেটা বই পাগলদের জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন। এইভাবে আইনি নোটিশ পাঠানো , আদতে সেই পাঠক – পাঠিকাদের সমগ্র সমাজকেই আঘাত করল। মলাট গ্রুপ পাঠক – পাঠিকাদের কিছু দুষ্প্রাপ্য বই খুঁজে এনে সুলভ করে দিয়েছেন। যা অকল্পনীয়”।
প্রকাশনার পক্ষ থেকে পাঠানো অ্যাডভোকেট এবং সলিসিটর নিরাজ কুমার সিং এর স্বাক্ষর করা আইনি নোটিশে মলাটের বিরুদ্ধে কপিরাইটের ১৪ ও ৬৩ নাম্বার ধারা সহ ইনফরমেশন টেকনোলোজি ২০০০ আইনের ধারাতেও অভিযোগ আনা হয়েছে এবং মলাটের বেশ কিছু সদস্যের নিজস্ব ফেসবুকে সেই নোটিশ আপলোডও করা হয়েছে।
ফেসবুক থেকে প্রাপ্ত প্রকাশনার নোটিশে জানা যাচ্ছে মলাট গ্রুপ তাদের প্রকাশনার বেশকিছু বইয়ের কপি পিডিএফ ফরম্যাটে নিজেদের গ্রুপে আপলোড করেছেন। নোটিশের ভাষায় যা নাকি আইনত অপরাধ।
প্রকাশনা সংস্থার পক্ষ থেকে বেশকিছু দাবীর সঙ্গে, লিখিত ক্ষমা চাইবার দাবীও করা হয়েছে।
বর্তমান সাহিত্যজগৎ এ এমুহূর্তের জনপ্রিয় বই ‘কালু ডোমের উপাখ্যান’ এবং ‘লোহার’ এর লেখক মণিশঙ্কর মণি জানালেন “দেখুন, বর্তমান প্রযুক্তিতে ডিজিটাল মিডিয়াকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। কিন্তু কোনো বইয়ের পিডিএফ করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ প্রকাশক ও লেখকের লিখিত অনুমতি নেওয়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। অনুমতি ব্যাতিরেকে ওকাজ করা অন্যায় বলেই আমিও মনে করি। কারণ, একটি গ্রন্থের পিছনে প্রকাশক আর লেখকের কী পরিমাণ শ্রম থাকে সেটা নিশ্চয় পৃথকভাবে বলে দেবার প্রয়োজন নেই। সুতরাং লেখক ও প্রকাশকের অনুমতিক্রমে পিডিএফ নিশ্চয় চলতে পারে।”
যদিও ফেসবুক মলাট গ্রুপের পক্ষে বিনিতা চ্যাটার্জী জানিয়েছেন ‘এ বিষয়ে তিনি কিছু এখনই বলতে চান না।
সাংবাদিক – লেখক – প্রকাশক চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য বলেন “মলাট গ্রুপ পিডিএফ শেয়ার করে ভুল করেছেন। একজন লেখকের মৃত্যুর পরও ৫০ বছর কপিরাইট থাকে। তারা ছাপাবইকে পিডিএফ করেছেন কোন আইনের অধিকারে”?
বই পাগল এমন মানুষ বাগুইআটি রঞ্জণাগলির বাসিন্দা স্বাগতা মাইতি জানান “দুস্প্রাপ্য বই যদি পিডিএফ হয়, বা যে সমস্ত বই বিগত ১০ বছরের উপর ছাপা হয় না বা একদম পাওয়াই যায় না সে সব বই পিডিএফ হলে আমাদের মতো পাঠকদের জন্যে খুব উপকারী। কিন্তু নতুন বই পিডিএফ হওয়াটা ঠিক মানতে পারলাম না। আমরা অর্থের জন্যে সবাই সব বই কিনতে পারিনা। এটা সত্য। তার জন্যে পিডিএফ বানানো ঠিক নয়”।
অভিযান পাবলিশার্সের পক্ষে মারুফ হোসেন জানান “আমি হলে মলাট গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করতাম না। আমি মলাট গ্রুপের সঙ্গে বসে আলোচনা করে সমস্যাটা মেটাতাম। কারণ বইয়ের ব্যবসা করে শুধুমাত্র প্রকাশক টাকা কামান এ ধারণাটা একদম ভুল। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ছাপাখানা, বই বাঁধাই, কাগজ বিক্রেতা, প্রুফ রিডার, ঠেলাওয়ালা, বিভিন্ন বইয়ের দোকান সহ লেখক – লেখিকা এবং সর্বশেষ পাঠক – পাঠিকাদের বৃহৎ একটা জগৎ। তবে মলাট বা যে কোন গ্রুপের উচিত পিডিএফ করার আগে লেখক / লেখিকা বা প্রকাশকের সামান্য অনুৃমতি নেওয়া। দুষ্প্রাপ্য বই বা যে বই হয়তো প্রকাশক ছাপতে চান না, অথচ পাঠকের খুব প্রয়োজন, এমন বই হলে নির্দ্বিধায় যেকোনো লেখক অনুমতি দিয়ে দেবেন বলে মনে করি। ছাপা বইয়ের সঙ্গে অনেকের জীবনধারণের বিষয় জড়িয়ে আছে, এই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটা সবার মনে রাখা দরকার। আর অন্যদিকে সব কিছু আদালতে মামলা করলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না”।
মিত্র এন্ড ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষে তাদের আইনজীবী বৈশালী ঘোষাল জানান “আমার ক্লায়েন্টের হয়ে নোটিশ দিয়েছি। আমি উত্তরের অপেক্ষায় আছি। এর বেশী কিছু বলতে চাই না। আগে তারা লিগ্যাল নোটিশের উত্তর দিক”!
বর্তমান রাজ্যসভার সাংসদ এবং প্রখ্যাত আইনজীবী শ্রী বিকাশরঞ্জণ ভট্টাচার্য প্রকাশনা সংস্থার আইনি নোটিশ পড়ে জানান “ফেসবুকের মলাট গ্রুপ ছাপা বইকে পিডিএফ করে নিজেদের ভিতর চালাচালি করে কোন অপরাধ করেননি। কারণ আমরাও রবীন্দ্র রচনাবলী বা অন্যান্য অনেক বই, আইনের বই বন্ধুবান্ধবদের ভিতর দেওয়া নেওয়া করি। ফেসবুকের মলাট গ্রুপও ঠিক তেমনই একটা প্রাইভেট গ্রুপ। তবে গ্রুপে কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রকাশককে বা যে কোন মানুষকে অপমানসূচক কথা বলে থাকেন, সে ক্ষেত্রে গ্রুপের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে নেওয়া উচিত বলে আমার ব্যক্তিগত মতামত। তবে তারা কেউই বইয়ের পিডিএফ করে নিজেদের ভিতর চলাচালি করে পরিবর্তে কেউই এক টাকাও নেননি। যারা দাবী করছেন মলাট গ্রুপ টাকা নিয়েছেন তারা কিসের ভিত্তিতে একথা বলছেন? তারা কোর্টে তাদের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবেন তো! ফেসবুকের মলাট গ্রুপ যদি আমার সাহায্য চান, আমি অবশ্যই তাদের আইনত সব রকম সাহায্য করব এবং মলাট গ্রুপের প্রতিটা সদস্য – সদস্যার পাশে আছি। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন”।