লতিফ মিয়া রংপুর থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে এক বছর আগে কাজের খোঁজে গাজীপুরে এসেছিলেন। তিনি ও স্ত্রী একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করে সাড়ে তিন হাজার টাকায় রুম ভাড়া নিয়ে ভালোই দিন পার করছিলেন। দু’জনে মিলে প্রতিমাসে প্রায় ১৬ হাজার টাকা বেতন পেতেন।
এক সন্তানকে একটি স্কুলে ভর্তিও করেছিলেন। কিন্তু মার্চ মাসে করোনা ভাইরাসের পাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় এপ্রিল মাস থেকেই তারা কর্মহীন হয়ে পড়েন। লকডাউন থাকায় গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যায়। সেসময় তারা গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে চলে যান। মে মাসে ফের গাজীপুরের ভোগড়া এলাকায় ওই ভাড়া বাসায় ওঠেন কিন্তু দুজনেরই আর চাকরি নেই। একমাস বিভিন্ন কারখানায় ছুটে বেড়িয়েছেন কাজের সন্ধানে।
কোনো কাজ না পেয়ে বাড়িওয়ালার তিন মাসের বাসা ভাড়া দিতেও হিমসিম খেতে হয়েছে। পরে এক মাসের ভাড়া কম দিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ৯ হাজার টাকায় একটি পিকআপ ভাড়া করে ৩০ জুন ফের গ্রামের বাড়ি রংপুরের উদ্দেশে রওনা দেন।যাওয়ার সময় লতিফ মিয়া বলেন, দেশে গিয়ে কী করব, কী খাবো তা ভেবে পাচ্ছি না। তারপরও উপায় নেই। এখানে থাকলেও খাওয়া ও বাসা ভাড়া দেয়ার সামর্থ নেই। কোথাও কোনো কাজ না পেয়ে চলে যাচ্ছি।
পরবর্তীতে সুবিধাজনক সময়ে ফের গাজীপুর আসবেন বলেও তিনি জানান।এভাবে প্রতিদিন গাজীপুরের টঙ্গী, কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, ভোগড়া, চান্দনা চৌরাস্তা, সালনা, বোর্ড বাজার, বড়বাড়িসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ ভাড়া বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে। করোনা ভাইরাসের কারণে গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কারণে অনেক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
এছাড়া বাড়ি ও ভবন নির্মাণসহ বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ বন্ধ থাকায় নির্মাণ শ্রমিকসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদেরও দুর্দিন চলছে। যার ফলে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা পরিবার পরিজন নিয়ে চলে যাচ্ছেন গ্রামে।এদিকে বাসা বাড়ি খালি হয়ে যাওয়ায় বাড়িওয়ালারাও পড়ছেন বিপাকে। যাদের বাসা ভাড়াই একমাত্র আয়ের উৎস তারা এখন চোখে শর্ষেফুল দেখছেন।ভোগড়া এলাকার বাড়িওয়ালা বিলকিস আক্তার জানান, তিনটি সন্তান রেখে ব্যবসায়ী স্বামী তিন বছর আগে মারা যান।
এরপর তিনি তার ৫টি আধাপাকা রুম ১৮ হাজার টাকায় ভাড়া দিয়ে সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে করোনার প্রভাবে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়ায় তার তিনটি রুমই খালি। এখন তিনি সংসার চালাবেন কিভাবে আর গ্যাস-বিদ্যুত বিল কিভাবে পরিশোধ করবেন তা নিয়ে চিন্তায় আছেন।
একইভাবে শরীফপুর এলাকার ৫তলা ভবনের মালিক আবুল হোসেন সাইদ জানান, চাকরি করে জীবনের সমস্ত সঞ্চয় এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ৫তলা বাড়ি করেছেন। এর মধ্যে করেনার প্রভাবে তার ১৫টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১০টিই দুই মাস ধরে খালি পড়ে আছে। এখন নিজের চলা এবং ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করাই দায় হয়ে পড়েছে।
অবস্থার উন্নতি না হলে কী হবে তা ভেবে পাচ্ছেন না।নির্মাণ শ্রমিক আতিকুর রহমান বলেন, দুই মাস ধরে তেমন কোনো কাজ নেই। টুকটাক কাজ যেখানে পাচ্ছি তাই করছি। ওই টাকা দিয়ে কোনো মতে দিনাতিপাত করছি। স্ত্রী গার্মেন্টে চাকরি করে।
এজন্য এখনো গাজীপুরে টিকে আছি।সরেজমিনে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শিল্প নগরী গাজীপুরের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই বাসা-বাড়ি খালি হয়ে যাচ্ছে। পোশাক কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন কর্মহীন হয়ে পড়ায় তারা বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন।
প্রতিদিনই ট্রাক ও পিকআপযোগে লোকজন তাদের আসবাবপত্র নিয়ে গাজীপুর ছেড়ে যাচ্ছেন।একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক আতাউর রহমান জানান, তার স্কুলটিতে মূলত ভাড়াটিয়াদের সন্তানরা লেখাপড়া করত। ৭টি রুম ভাড়া নিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। চার মাস যাবৎ স্কুল বন্ধ থাকায় এবং ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবকরা গাজীপুর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় স্কুলটি এখন প্রায় শিক্ষার্থীশূন্য। স্কুলের ভাড়া এবং শিক্ষাকদের বেতন দিতে পারছি না তিনমাস ধরে।
করোনা পরিস্থিতি এবং দেশের অর্থনীতি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আমরা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াব তা বুঝে উঠতে পারছি না।এ বিষয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ১৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফয়সাল আহমাদ সরকার বলেন, গাজীপুর শিল্প সমৃদ্ধ এলাকা। যার মধ্যে পোশাক কারখানাই বেশি। করোনা ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন গার্মেন্টসে কাজের অর্ডার কমে গেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
যার কারণে শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজে না পাওয়ায় এলাকা ছেড়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। এতে বাসা বাড়িও খালি হয়ে যাচ্ছে। তবে পোশাক কারখানাগুলোতে কাজের অর্ডার এলে এবং বন্ধ কলকারখানাগুলো খুললে গ্রামে শ্রমিকরা ফের গাজীপুরে ফিরে আসতে পারেন।