প্রবাস ডেস্ক
‘আমি ইউরোপ যেতে চাই’ মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ভূমধ্যসাগরের উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে সিরিয়ানদের জন্য এই একটি হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজই যথেষ্ট। সিরিয়া থেকে লিবিয়া, এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন-মাঝে ভূমধ্যসাগর।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় বাস্তচ্যুত হয়েছেন অনেক মানুষ। কাজ নেই। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তুলেছে। এ অবস্থায় উন্নত জীবনের আশায় এই মানুষগুলো মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে হলেও নৌকায় চড়ে পাড়ি দিতে চান ভূমধ্যসাগর। কেউ কেউ সফল হন, কেউ কেউ হন না। উত্তাল সাগরে ডোবে নৌকা। প্রাণহানি হয় শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষের।
গত জুন মাসে এমন একটি নৌকা লিবিয়া থেকে যাত্রা করে কমপক্ষে ১৪১ জন সিরিয়ানকে নিয়ে গ্রিস উপকূলে ডুবে যায়। বেশিরভাগ যাত্রীই মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়। বার্তা সংস্থা এএফপি মৃতদের আত্মীয় ও উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক পাচারকারীদেরও সাক্ষাৎকার নেয় তারা।
‘আমরা ফোনেই সব চূড়ান্ত করি,’ সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের দারা প্রদেশের এক পাচারকারী বলেন, ‘পাসপোর্টের কপি চাই এবং কোথায় টাকা পাঠাতে হবে তা জানাই। কারো সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করি না,’ হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় এএফপিকে জানান তিনি।
সিরিয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলনের একটি কেন্দ্র ছিল দারা প্রদেশ। এই প্রদেশ ২০১৮ সালে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে।
তখন থেকেই এখানে হত্যা, সংঘাত চলতে থাকে। মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এভাবেই এই জায়গাটির অধিবাসীরা ইউরোপে পাড়ি দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।
‘প্রথম বছর আমরা কেবল একটি দল পাঠাই। আজ প্রতি মাসে একটি দল লিবিয়ায় পাঠাই,’ পাচারকারীর ভাষ্য। ‘মানুষ তাদের ভিটেমাটি বিক্রি করে পালাচ্ছেন।’
যে বছর সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়, সেই ২০১১ সালেই ন্যাটো সমর্থিত একটি জনবিক্ষোভে লিবিয়ার একনায়ক মোয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যু হয়। উত্তর আফ্রিকার দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত। পশ্চিমে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার এবং পূর্বে সামরিক নেতা খালিফা হাফতারের কমান্ড। হাফতারের সঙ্গে দামেস্কের যোগাযোগ আছে।
এমন পরিস্থিতিতে, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সিরিয়ানরা প্রায় ছয় হাজার ডলার (ছয় লাখ টাকার কিছু বেশি) দিয়ে যাত্রার প্রক্রিয়া শুরু করেন।
কয়েকজন মানবপাচারকারীর সঙ্গে কথা বলে এএফপি জানতে পেরেছে, এই অর্থের বিনিময়ে তারা লিবিয়ায় বিমানের টিকিট, লিবিয়ার পূর্বাংশে যাওয়ার ডকুমেন্ট, এয়ারপোর্ট পিকআপ, পরিবহন, থাকার জায়গা, ইতালির উদ্দেশ্যে নৌকায় যাত্রা, লাইফজ্যাকেট ইত্যাদি পেয়ে থাকেন।
কারো কারো কাছ থেকে বেশি টাকাও নেওয়া হয়। যেমন দারা প্রদেশ থেকে আসা ওমর আট হাজার ডলার খরচ করেছেন। কিন্তু তারপরও তিনি ভালো ব্যবহার পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।
২৩ বছরের এই যুবক বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, নির্যাতন করা হয়েছে।’ তাদের ঠিকমত খাবার দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তবে ওমর শেষ পর্যন্ত ইতালিতে পৌঁছেছেন।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল তুরস্কপন্থি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। সেখান থেকেও লিবিয়ায় লোক পাঠানো হয়। তাদের তুরস্কপন্থি ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে দেখিয়ে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের প্রশাসন তুরস্ক সমর্থিত। আঙ্কারা অবশ্য তুরস্ক হয়ে ইউরোপ ঢোকার পথ অনেকটাই বন্ধ করে দিয়েছে।
এর বাইরেও আরও কয়েকটি রুট দিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ভূমধ্যসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এগুলো করতে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদেরও পয়সা খাওয়াতে হয় বলে জানান কয়েকজন মানবপাচারকারী। সমুদ্রপথ কঠিন, উত্তাল। সে পথে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইএমও বলছে, এ বছর এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৮০০ অভিবাসনপ্রত্যাশী যাত্রাপথে মারা গেছেন।