রংপুর সংবাদদাতা
আঁশবিহীন, মিষ্টি ও সুস্বাদু হাঁড়িভাঙ্গা আমের যাত্রা শুরু হয়েছিল রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তেকানী গ্রাম থেকে। এ গ্রামেই রোপণ করা একটি গাছের কলম থেকে এখন কয়েক লাখ আমগাছ হয়েছে। বদলে দিয়েছে আশপাশের মানুষের ভাগ্য। বদলে গেছে গ্রামের দৃশ্যপটও। হাঁড়িভাঙ্গা পরিণত হয়েছে রংপুরের ‘ব্র্যান্ডে’।
তবে শুরুতে এ আমের নাম হাঁড়িভাঙ্গা নয়, মালদিয়া ছিল। মালদিয়া আমের নাম হাঁড়িভাঙ্গা হয়ে ওঠার গল্প জানা গেল তেকানী গ্রামের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন পাইকারের কাছে। তাঁর বাবা নফল উদ্দিন পাইকারকে সবাই বৃক্ষপ্রেমী হিসেবেই চিনতেন। তেকানী গ্রামে এখনো দাঁড়িয়ে থাকা হাঁড়িভাঙ্গা আমের মাতৃগাছটি রোপণ করেছিলেন নফল উদ্দিন।
প্রচণ্ড দাবদাহে এবার নির্ধারিত সময়ের আগে পাকতে শুরু করেছে হাঁড়িভাঙ্গা আম। আমচাষিদের দাবির মুখে নির্ধারিত সময়ের ১০ দিন আগে আম পাড়া মৌসুম শুরু হচ্ছে। আজ শনিবার থেকে বাজারে পাওয়া যাবে হাঁড়িভাঙ্গা আম। এবার ২৫০ কোটি টাকার হাঁড়িভাঙ্গা আম বেচাবিক্রি হতে পারে বলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও চাষিদের ধারণা।
আমজাদ হোসেন পাইকার জানান, সেটা ছিল খুব সম্ভবত ১৯৪৯ সাল। মিঠাপুকুরের উঁচা বালুয়া গ্রামটি ছিল ঝোপজঙ্গলে ভরপুর। সেই এলাকার জমি থেকে একটি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন তাঁর বাবা নফল উদ্দিন। তখন এর নাম ছিল মালদিয়া।
আমজাদ হোসেন বলেন, আমগাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে ফিল্টার বানিয়ে পানি দেওয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে। তবে গাছে বিপুল পরিমাণ আম ধরে। সেগুলো ছিল খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে মানুষ ওই আম সম্পর্কে জানতে চায়। তখন নফল উদ্দিন মানুষকে বলেছিলেন, যে গাছে লাগানো হাঁড়িটি মানুষ ভেঙে ফেলেছে, সেই হাঁড়িভাঙ্গা গাছের আম এগুলো। তখন থেকেই ওই গাছটির আম ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ নামে পরিচিতি পায়।
সুস্বাদু ও মিষ্টি হওয়ায় সেই মাতৃগাছ থেকে জোড়া কলম করার হিড়িক পড়ে যায়। এলাকার মানুষ জোড়া কলম নিয়ে লাগাতে থাকেন। গড়ে উঠতে থাকে বাগান। নফল উদ্দিন পাইকার মারা যাওয়ার পর হাঁড়িভাঙ্গা আমের মাতৃগাছে মানুষ এসে এত জোড়াকলম করতে লাগলেন যে গাছটির ডালগুলো হেলে পড়া শুরু করল। এরপর আশির দশকে বাণিজ্যিকভাবে গাছের কলম করে মানুষজন আমবাগান গড়ে তুলতে নেমে পড়ে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আঁশবিহীন হাঁড়িভাঙ্গা আম অত্যন্ত মিষ্টি ও সুস্বাদু। আমের আঁটিও খুব ছোট। প্রতিটি আম ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। প্রায় ৩২ বছর আগে এই আমের চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু হলেও এর তেমন একটা প্রচার ছিল না। তবে গত ২২ বছর থেকে ধীরে ধীরে প্রচার পেতে থাকে। রংপুরের মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকায় উৎপাদিত হচ্ছে এই আম। কেননা, এ এলাকা হলো এই আমের উপযোগী লাল মাটি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, হাঁড়িভাঙ্গা আম রংপুর অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকেই পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমটি দেশে-বিদেশে খ্যাতি পেয়েছে। কার্যকর উদ্যোগ নিলে এই আম দিয়ে বছরে কয়েক শ কোটি টাকার বাণিজ্য সম্ভব।
জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ও রানীপুকুর ইউনিয়ন, পদাগঞ্জ এলাকাসহ আরও কিছু আশপাশ এলাকায় চাষাবাদ হয়ে আসছে এই আম। আম পাড়ার মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই এখনো আমের বাগান ও গাছ এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকার আম ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন চাষিরা। আমচাষি ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবছর জুনের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আম পাড়ার উৎসব শুরু হলেও এবার শুরু হয়েছে প্রথম সপ্তাহের পর।
মিঠাপুকুরের লুৎফর রহমান ও আবদুস সালাম সরকার নামের দুই ব্যক্তি ১৯৯০ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ শুরু করেন। তিনি এ বছর ১৬ একর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ করেছেন। তিনি বলেন, আমের মৌসুমে এ এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় হলেও এখানে আম প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য একটিও হিমাগার নির্মাণ করা হয়নি। বিপণনব্যবস্থাও খুব দুর্বল। রাস্তাঘাট এখনো খুব খারাপ। ফলে আমের বাজার পেতে অনেকটা কষ্ট পেতে হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও চাষিরা জানিয়েছেন, হেক্টরপ্রতি আম ফলনে ব্যয় হয় ২৮-৩০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে প্রতি হেক্টর জমি বর্গা নিতে ব্যয় ২০-২৫ হাজার টাকা। এতে প্রতি হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
কৃষি বিভাগের হিসাবমতে, প্রতি হেক্টরে ৩০০ থেকে ৩২৫ মণ আম উৎপাদিত হয়ে থাকে। বর্তমান আমের মণপ্রতি বাজার দর অনুযায়ী সর্বনিম্ন ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। প্রতি হেক্টরের আম বিক্রি থেকে চাষিদের আয় হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ টাকার ওপরে।
বর্তমানে রংপুরের তরুণ ও যুবকেরা হাঁড়িভাঙ্গা আমকে ঘিরে ব্যবসা শুরু করেছেন। আমের মৌসুমে তাঁরা চাষিদের আম কিনে বিভিন্ন স্থানে পাঠাচ্ছেন। বিশেষ করে মিঠাপুকুরের লালপুর, পদাগঞ্জ, তেয়ানিসহ আশপাশের গ্রামের যুবকেরা এখন আম ব্যবসায় জড়িয়ে বেকারত্ব দূর করেছেন।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, ওই এলাকায় প্রায় ১৭ লাখের অধিক হাঁড়িভাঙ্গা আমগাছ রয়েছে। এ বছর ১ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে রয়েছে হাঁড়িভাঙ্গা আম। গত বছর ১ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছিল। গরম হওয়ায় আমের আকার কিছুটা ছোট হলেও ফলন ভালো হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ১২-১৫ টন আম পাওয়া যাবে।
বা বু ম / অ জি