শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সব থেকে প্রিয় রাজনৈতিক শিষ্য। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিলো সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় পরিচালিত। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ও শেখ মনির সম্পর্ক শুধু রক্তের বন্ধন দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। সেই সম্পর্ক ছিল অন্তরাত্মার।
ঘাতকরা জানত বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করতে হলে শেখ মনিকে আগে আঘাত করতে হবে।
বাংলাদেশের পললভূমিতে ‘ম্যাকিয়াভেলিয়ান প্রিন্স’ শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি ১৯৩৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শেখ নূরুল হক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নীপতি, মা শেখ আছিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম প্রধান গেরিলা বাহিনী মুজিব বাহিনী তাঁর নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত এবং পরিচালিত হয়। এ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
স্বাধীন – সার্বভৌম লাল সবুজের পতাকা খচিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এই মুজিব বাহিনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অনস্বীকার্য।
শেখ ফজলুল হক মনি ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে অনেক স্নেহ করতেন ও ভালবাসতেন। ছাত্র অবস্থাতেই শেখ মনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
তিনি ঢাকা নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ১৯৬০ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে ড. আলীম আল রাজী কলেজ থেকে তিনি আইনের উপর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাশ করেন।
শেখ ফজলুল হক মনি – নামটি শুনলে আমাদের সামনে একজন যুবনেতার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনের সোনালী সময় ছাত্র রাজনীতি, কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিক রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন।
মামা বঙ্গবন্ধু ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা, যুবনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতা। তাই ছোটবেলা থেকেই শেখ মনির আদর্শ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শেখ মনি বঙ্গবন্ধুকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাঁর চোখের ভাষা সহজেই বুঝতে পারতেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই শেখ মনি রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ কারণেই ভাগ্নেকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন।
ছাত্রজীবন থেকেই শেখ মনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি করা কালীন সময়ে তিনি ছিলেন সাধারণ ছাত্রদের প্রাণের স্পন্দন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে তিনি বারংবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন।
৬০ এর দশকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি শুরু করেন শেখ মনি। তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের কারণে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আইয়ুব – মোনায়েম খান তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে অন্যতম বড় শত্রু বিবেচনা করতেন।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের ফলে রাজনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসে। অর্থাৎ ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল এই তিন বছরের মধ্যে আড়াই বছরই প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আর এ সময় গোপনে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু রেখে ছাত্র ইউনিয়ন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তাই দলকে শক্তিশালী করতে গোপন রাজনীতির বিকল্প ছিল না।
শেখ মনির প্রধান কাজ হয়ে পড়ল ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জীবিত করা। যেহেতু রাজনীতি সংকটে, তাই শেখ মনি ছাত্রলীগকে ভিন্ন নামে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন।
শেখ ফজলুল হক মনি শিল্প ও সাহিত্য সঙ্ঘের আড়ালে ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে তিনি একটি বাহিনী গঠন করলেন এবং এই বাহিনীকে তিনি ছাত্রলীগ কর্মী আখ্যায়িত করতেন ; যাকে পরে সিরাজুল – রাজ্জাক সাহেবরা ‘নিউক্লিয়াস ‘ নাম দিয়েছিলেন। বাস্তবতা এই যে, শুরুটা শেখ মনির হাত দিয়ে হয়েছিল।
নিউক্লিয়াস ছিল পাঁচ বা দশ সদস্যের বিশেষ কর্মী দল, যারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা কামনা করে। সঙ্গত কারণে প্রায় সব ছাত্রলীগ কর্মীই এ মনোভাব পোষন করতেন। শেখ মনি বলতেন, তারা তাদেরই ছাত্রলীগে নিতেন ; যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং দেশের স্বাধীনতা কামনা করত।
শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন মেধাবী ও সাহসী। সেই সময়ের বক্র রাজনীতির মধ্যেও তিনি আইয়ুব খানের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ভাগ্নে হিসাবে নয়, ষাটের দশকের গোড়া থেকেই শেখ ফজলুল হক মনি নিজের মেধা ও অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা বলে দেশের ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন।
উত্তাল সেই আন্দোলন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা স্মৃতি কথায় বলেন, “মনে পড়ে ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মনি ভাই এই বাড়ি থেকে নির্দেশ নিয়ে যেতেন, পরামর্শ নিতেন। ১৯৬২ সালে আব্বা গ্রেফতার হন। তখনকার কথা মনে পড়ে খুব।”
ষাটের দশকের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি আন্দোলনে শেখ মনি ভূমিকা রেখেছেন। বাংলার কুলাঙ্গার মোনায়েম খানের হাত থেকে সার্টিফিকেট না নেয়ার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের নিকট থেকে সনদপত্র গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলন শুরু করেন।
যারা মোনায়েমের হাত থেকে উপাধিপত্র নেয়ার জন্য সভাস্থলে হাজির হয়েছিলেন, তারা উল্টো শেখ মনির নেতৃত্বে সভাস্থল বয়কট করেন এবং মোনায়েম খানকে প্রকাশ্যে বর্জন করেন; উপাধিপত্র না নিয়েই তারা ফিরে যান। এই আন্দোলন ব্যাপক রূপ ধারণ করে। প্রবল ছাত্র বিক্ষোভে সমাবর্তন পণ্ড হয়ে যায়।
ক্ষুব্ধ সরকার প্রতিশোধ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করে। প্রায় দেড়শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে মোনায়েম খান ক্ষমতার দম্ভ দেখান।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি মামলায় সুপ্রীম কোর্টের রায়ে জয়লাভ করে ডিগ্রি ফিরে পান।
১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন।
শেখ মনির রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার পক্ষে হরতাল সফল করে তোলা। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী – আব্দুর রাজ্জাক। শেখ মনি ঢাকা – নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের পথসভা ও গেটসভা করতে বললেন এবং সমস্ত ঢাকাকে ১১ টা ভাগে ভাগ করে দায়িত্ব বন্টন করে দিলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে মুনিরুল ইসলাম, আলী আহমেদ (চুনকা), গোলাম মূর্শীদ (এস.সি.এ), আনসার সাহেব, চকবাজারের রিয়াজুদ্দিন ও নাজিরা বাজারের সুলতান সাহেব, ফজলুর রহমান, নিজাম সাহেব পুরাতন ঢাকার।
নতুন ঢাকার কর্মীদের পরিচালনার জন্য জনাব আনোয়ার চৌধুরী, ময়েজউদ্দিন আহমেদ, জনাব নুরুল ইসলাম। মিসেস আমেনা বেগম ও গাজী গোলাম মোস্তফাকে সবকিছু দেখা শুনা করার দায়িত্ব দিলেন। ছাত্রদের ১১ টা গ্রুপের সার্বিক নেতৃত্বের ভার দিলেন জনাব মিজান চৌধুরীকে। তেজগাঁও, আদমজী পোস্তগোলাসহ শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করেছিলেন।
এমনকি মানিক মিয়া বললেন, ইত্তেফাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তিনি পিছপা হবেন না। তিনি আরও আশ্বাস দিলেন, হরতালের কর্মসূচী যাতে করে সব কাগজে ছাপা হয় তার জন্য প্রভাব বিস্তার করবেন।
বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে জানতে চেয়েছেন হরতালের প্রস্তুতি কতদূর কি হলো? গভীর রাতে পিছনের দেওয়াল টপকিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তার মামিকে সবকিছু বিস্তারিত জানিয়ে বললেন, রাতের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর নিকট খবর পৌঁছে দাও হরতাল হবেই।
তিনি যেহেতু ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করছিলেন; সেই সঙ্গে ঢাকা – নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের হরতালের পক্ষে তিনিই সংগঠিত করেছিলেন।
এই হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম হয়ত পিছিয়ে যেত।
১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং মোনায়েম খান শেখ মনিকে কারারুদ্ধ করেন। এ সময় বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়।
তিনি মুক্তি পান ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর।
দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য গোটা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন – সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রাখেন শেখ মনি। তিনি ছিলেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনমুখী কর্মসূচীর অন্যতম প্রণেতা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শেখ ফজলুল হক মনির উদ্যোগে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়। মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। আওয়ামী লীগ ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। প্রায় পাঁচ হাজার সদস্যের এ বাহিনীকে চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং এর নেতৃত্বে ছিল ১৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমান্ড।
প্রথমদিকে সেক্টর কমান্ডার গন ভারতের ব্যারাকপুর, শিলিগুড়ি, আগরতলা ও মেঘালয় থেকে নিজ নিজ বাহিনী পরিচালনা করতেন। এ বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাক। শেখ ফজলুল হক মনি মুজিব বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেরাদুন পাহাড়ি এলাকায় এ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
ধারণা করা হয় মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সম্ভাব্য বিকল্প নেতৃত্বের প্রয়োজন মোকাবেলার জন্য মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।
চলবে….
এ্যাডভোকেট শেখ নবীরুজ্জামান বাবু
বৃত্তিপ্রাপ্ত পিএইচডি গবেষক (ঢাবি)
সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ
সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ