স্টাফ রিপোর্টার-
গ্রামের সহজ সরল মানুষদের টার্গেট করে কৌশলে তাদের এনআইডি সংগ্রহ করত একটি দালাল চক্র। এরপর এডিটিং এর মাধ্যমে ছবি বদলে সেই এনআইডি দিয়ে তৈরি হচ্ছিল বাংলাদেশে পাসপোর্ট। এমন এক ভয়ংকর চক্রের ২৩ সদস্যকে আটক করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবি পুলিশ বলছে, চক্রের সদস্যরা শুধু পাসপোর্ট ই না, এনআইডি, জন্মনিবন্ধনের মত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস তারা নিমিষেই তৈরি করে দিচ্ছিল রোহিঙ্গাদের। অবৈধভাবে তৈরি এসব পাসপোর্ট, এনআইডি, জন্মনিবন্ধন ব্যবহার করে শতশত রোহিঙ্গা বিদেশে পারি জমিয়েছে। সেখানে গিয়ে তারা নানা রকম অপরাধ সংঘটিত করছে, যা একটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকীস্বরুপ।
দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ২৩ জনকে গ্রেফতারের পর এমনটাই জানিয়েছে তারা।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- রোহিঙ্গারা নাগরিক উম্মে ছলিমা ওরফে ছমিরা, মরিজান ও রশিদুল। রোহিঙ্গা দালাল আইয়ুব আলী ও মোস্তাকিম। আনসার সদস্য দুজন হলেন, জামসেদুল ইসলাম ও মো. রায়হান। দেশী দালালরা হলেন, রাজু শেখ, শাওন হোসেন ওরফে নিলয়, ফিরোজ হোসেন, তুষার মিয়া এছাড়া বিভিন্ন ধাপের দালালরা হলেন, শাহজাহান শেখ, শরিফুল আলম, জোবায়ের মোল্লা, শিমুল শেখ, আহমেদ হোসেন, মাসুদ আলম, আব্দুল আলিম, মাসুদ রানা, ফজলে রাব্বি শাওন, রজব কুমার দাস দীপ্ত, আল-আমিন, মো সোহাগ।
সোমবার(২৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার(ডিবি) হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের একাধিক টিম রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট সংক্রান্ত ডকুমেন্টস, পাসপোর্ট এবং কম্পিউটারসহ ৩ রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ, ১০ জন বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করে।
তাদের দেয়া তথ্য সংগৃহীত ডকুমেন্টস বিশ্লেষণ করে ২৫ ফেব্রুয়ারি দিনে ও রাতে কক্সবাজার, টাঙ্গাইল এবং ঢাকায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে দুই আনসার সদস্যসহ রোহিঙ্গা ও বাঙালি দালাল চক্রের ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারদের হেফাজত থেকে মোট ১৭ টি পাসপোর্ট, ১৩ টি এনআইডি, ৫ টি কম্পিউটার, ৩ টি প্রিন্টার, ২৪ টি মোবাইল ফোন এবং পাসপোর্ট তৈরির সংশ্লিষ্ট শত শত দলিলপত্র জব্দ করা হয়।
শক্তিশালী এই চক্রটি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষদেরকে লক্ষাধিক করে টাকার বিনিময়ে জন্ম সনদ, এনআইডি ও পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়।
গ্রেফতার চক্রটির একটি দল কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি থেকে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। আরেকটি দল এদের জন্য জন্ম সনদ, এনআইডি বানিয়ে দেয়। সর্বশেষে অন্য দলটি ঢাকাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আনসার সদস্যদের মাধ্যমে ব্যাংকে এক্সপ্রেস, সুপার এক্সপ্রেস ধরনের টাকা জমা দেয়া, বায়োমেট্রিক্স করা ও ছবি তুলার ব্যবস্থা করে দেয়। ছয় ঘন্টার মধ্যে জন্ম সনদের জন্য এরা ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা নেয়। তিন দিনের মধ্যে এনআইডি করে নেয়ার জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং পাসপোর্ট তৈরি করার জন্য ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে থাকে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে।
গোয়েন্দা প্রধান বলেন,গ্রেফতার দালালদের মোবাইলে শত শত পাসপোর্ট করে দেয়ার প্রাসঙ্গিক সফট ডকুমেন্টস, ডেলিভারি স্লিপ পাওয়া গিয়েছে। যার মধ্যে গত তিন মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য করা ১৪৩ টি পাসপোর্ট ইতোমধ্যে তারা সরবরাহ করেছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি রোহিঙ্গাদের, বাংলাদেশী দাগি অপরাধীদেরকে ভিন্ন নাম ও ঠিকানায় হাজার হাজার পাসপোর্ট করে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
হারুন বলেন, গ্রেফতাররা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রংপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও বরিশাল জেলার ঠিকানা ব্যবহার করে জন্ম সনদ ও এনআইডি বানিয়ে তার ভিত্তিতে পাসপোর্ট বানিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, প্রযুক্তি অনুশীলনে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ডাটা, ডিজিটাল জন্ম সনদ ডাটা, স্মার্ট এনআইডি ডাটা ব্যাংক আছে যেখানে বিভিন্ন বায়োমেট্রিক্স, ছবিসহ নানা তথ্য সংরক্ষিত। এ সকল তথ্য কোনরকম ভেরিফাই না করেই ইচ্ছামতো তৈরি করা কাগজপত্রের ভিত্তিতে পাসপোর্ট অফিসে যে কেউ দালালদের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে, বায়োমেট্রিকস দিতে এবং পাসপোর্টের জন্য ছবি তুলতে পারে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের স্মারক পাসপোর্ট তৈরীর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে রোহিঙ্গা ডাটা, ডিজিটাল জন্ম সনদ ডাটা এবং স্মার্ট এনআইডি ডাটা ভেরিফাই করলেই রোহিঙ্গাসহ নন-বাংলাদেশিদেরকে সনাক্ত করা সম্ভব।
পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে তো এসবি পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজ করে। তখন কেন ধরা পড়ে না? জানতে চাইলে হারুন বলেন, ধরা পড়বে কি করে? একজনের হাতে জন্ম সনদ, এনআইডি তুলে দেবার পর সে যখন জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট করতে দেবে তখন তো পুলিশ দেখে মোবাইল নাম্বার। সেই নাম্বারে যোগাযোগ করলে সে সব বলে দেয়, কারণ তাকে তো সব শেখানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ বর্তমান ঠিকাতে যায়। রোহিঙ্গা নাগরিক স্থায়ী ঠিকানা কক্সবাজার দিলেও বর্তমান ঠিকানা সে ব্যবহার করে।
পাসপোর্টসহ হাসপাতাল ও সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে আনসার সদস্যরা কাজ করছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দালালদের সঙ্গে মিলিয়ে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। আপনার এবার দুই আনসার সদস্যকে গ্রেফতার ও করেছেন। তাদের ব্যাপারে তদন্ত করবেন কিনা? জানতে চাইলে হারুন বলেন, আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি আমরা আনসারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।
পাসপোর্ট জালিয়াতি কিংবা অবৈধভাবে পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কেউ জড়িত থাকার তথ্য আপনারা পেয়েছেন কি-না জানতে চাইলে ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার হারুন বলেন, বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। আমার মনে হয় এভাবে হাজার হাজার পাসপোর্ট রোহিঙ্গারা নিয়ে যাচ্ছে, দাগি আসামীরা নিচ্ছে। অথচ কোনো কোনো ভেরিফিকেশন করা হয় না, তাদের ডাটাবেইজে তো দেশী নাগরিক ও রোহিঙ্গাদের সবার বিস্তারিত ডাটা রয়েছে।
দাগি আসামীদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক দাগি আসামীও এভাবে পাসপোর্ট করেছে। তাদের নাম পরিচয় ও আমরা তদন্তের স্বার্থে জানাচ্ছি না। গ্রেফতারদের আদালতে সোপর্দ করে আবেদন করা হলে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আরও যারা যারা জড়িত তাদের নাম পরিচয়ও বেড়িয়ে আসবে।