ভিটামিন ডি-এর সঙ্গে কোভিড সংক্রমণের সরাসরি যোগসূত্র আছে কিনা সেটা প্রমাণিত নয়। তবে বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভিটামিন ডি-এর অভাব যার যত বেশি, তার শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিও ততটাই বেশি। সোনা রোদ যদি গায়ে না লাগে, তাহলে অসুখও যাবে না। ডাক্তারের নিদান শুধু নয়, মা-ঠাকুমারাও এমন কথাই বলেন।
কড়কড়ে রোদ মানেই ভিটামিন ডি। আর ভিটামিন ডি মানেই শরীরের হাজারো সমস্যার সমাধান। এর অভাবে শুধু হাড় ক্ষয়ে যাওয়া বা গা ম্যাজম্যাজে ব্যথা-বেদনা নয়, আরও নানা রোগ উড়ে এসে জুড়ে বসে শরীরে। আর রোগ মানেই দুর্বল শরীর, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়াদের হুল্লোড় শুরু হয়ে যায়। গবেষকরা বলছেন, ভিটামিন ডি যখন অনেক কাজেরই কাজী, তখন এর ঘাটতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণেরও একটা কারণ হতে পারে। ভিটামিন ডি-এর অভাব যার যত বেশি, তার শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিও ততটাই বেশি। যদিও এই তথ্যের কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ এখনও দিতে পারেননি বিজ্ঞানীরা, তবে প্রাথমিক গবেষণায় অনেক বিজ্ঞানীরই অনুমান, ভিটামিন ডি-এর অভাব এবং কোভিড সংক্রমণের মধ্যে একটা যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। ‘কুইন এলিজাবেথ হসপিটাল ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট’ ও ‘ ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়া’-র গবেষকরা ভিটামিন ডি ঘাটতির সঙ্গে সার্স-কভ-২ ভাইরাস সংক্রমণের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করছেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোভিড রোগীদের উপর সমীক্ষা চালিয়ে একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া। গেছে যে, দুর্বল শরীর ও ক্রনিক রোগ যাদের আছে, তারাই বেশি আক্রান্ত এই ভাইরাসের সংক্রমণে। রিস্ক ফ্যাক্টর অবশ্য আরও আছে। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম, তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বাকিদের থেকে বেশি। এখন রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে ভিটামিন ডি-এর ভূমিকার কথা কারও অজানা নয়। দেখা গেছে, বেশিরভাগ কোভিড রোগীরই শরীরে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি রয়েছে। তবে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট দিয়ে কোভিড সংক্রমণ কমানো যাবে কিনা সে ব্যাপারে কোনও তথ্য এখনও সামনে আসেনি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভিটামিন ডি যদি শরীরে সঠিক মাত্রায় থাকে, তাহলে সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে। ভিটামিন ডি-এর উৎস হল সূর্যালোক।
সূর্যের আলোয় শরীর নিজেই ভিটামিন ডি বানিয়ে নিতে পারে। এর পাশাপাশি কিছু খাবারও আছে যা ভিটামিন ডি-র অভাব পূরণ করতে পারে। সামুদ্রিক মাছ, মাছের তেল, দুধ, দই জাতীয় খাবারেও ভিটামিন ডি থাকে। গবেষকরা বলছেন, ভিটামিন-ডি সাপ্লিমেন্টও দ্রুত কাজ করে। তবে মুঠো মুঠো ট্যাবলেটের বদলে রোদে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করা অনেক বেশি ভাল। ডায়েট দিয়েও অভাব মেটানো যায়। তবে আজকাল রোদে বার হলেই লোকজন গাদা গাদা সানস্ক্রিন মেখে নেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন এসপিএফ ১৫ বা তার বেশি এসপিএফ-এর সানস্ক্রিন ত্বকে ভিটামিন ডি-এর উৎপাদন অনেক কমিয়ে দেয়। ডায়াবিটিসের রোগীদের জন্য ভিটামিন-ডি মহার্ঘ দাওয়াই। প্রি-ডায়াবিটিকদের জন্য ভরসার হাত। প্রি-ডায়াবেটিক ২০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের উপর ভিটামিন-ডি প্রয়োগ করে দেখা গেছে, এদের শরীর-স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে দুরন্ত গতিতে। মেদ ঝরেছে, রক্তে শর্করার পরিমাণও বাড়েনি। ভিটামিন ডি-এর ঘাটতিকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয় ভিটামিন ডি ডেফিশিয়েন্সি (ভিডিডি)। দেখা গেছে, ৬ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সী প্রায় ৭০ শতাংশ মেয়েই ভিডিডি-তে ভোগেন।
তাছাড়া ৬০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ ও মহিলারাও এই রোগের শিকার। ভিডিডি-র ফলে শুধু হাড়ের সমস্যা নয়, হরমোনের অসমতাও হতে পারে। ফলে, বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয় ভিটামিন ডি-র অভাব। দীর্ঘদিন ভিটামিন-ডি এর অভাব হলে মস্তিষ্কের সমস্যা, স্মৃতিনাশ হতে পারে। রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও এই ভিটামিন সেরার সেরা। এটি ছাড়া ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসদের প্রতিহত করা দুঃসাধ্য।
ছোটদের রিকেট থেকে শুরু করে বড়দের অস্টিওম্যালশিয়া, অস্টিওপোরেসিস প্রভৃতি নানাবিধ রোগ হয় ভিটামিন ডি-এর অভাবে। গবেষকরা বলছেন, কোভিড রোগীদের মধ্যে যেসব ক্রনিক রোগ দেখা গেছে তার বেশিরভাগই ভিটামিন ডি-এর অভাবে হয়ে থাকে। তাছাড়া সমীক্ষায় এও দেখা গেছে, ইউরোপের যে ২০টি দেশে কোভিড সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে, সেখানকার মানুষজনের ভিটামিন ডি এর ঘাটতি রয়েছে। কুইন এলিজাবেথ হসপিটাল ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক করোনা রোগীকে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রাইব করা হয়েছে। দেখা গেছে, তাঁদের শারীরিক অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব গ্রানাডার বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি ভিটামিন ডি ও কোভিড সংক্রমণের যোগসূত্র খোঁজা জন্য একটি পরীক্ষা চালাচ্ছেন।
গবেষকরা বলছেন, ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট দিয় দেখা গেছে, ৫০ শতাংশ রোগীর শ্বাসের সংক্রমণ, বুকে ব্যথা কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড রোগীদের সেরাম স্যাম্পেল নিয়েও তাতে ভিটামিন ডি-এর মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। সাধারণত দেখা যায় সেরামে ভিটামিন ডি থাকে গড়ে ৫৬ ন্যানোমোল প্রতি লিটার। যদি এই মাত্রা ৩০ ন্যানোমোল/লিটার হয়ে যায়, তাহলে চিন্তার কারণ রয়েছে। সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, স্পেনের লোকজনের সেরামে ভিটামিন ডি-এর মাত্রা ২৬ ন্যানোমোল/লিটার, ইতালিতে ২৮ ন্যানোমোল/লিটার এবং উত্তর ইউরোপের দেশগুলিতে ৪৫ ন্যানোমোল/লিটার। সুইৎজারল্যান্ডের বেশিরভাগ লোকজনের সেরামে ভিটামিন ডি রয়েছে ২৩ ন্যানোমোল/লিটার।
ইতালিতে আবার দেখা গেছে, ৭৬ শতাংশ মহিলা ও পুরুষ যাদের বয়স ৭০ বছরের উপরে তাদের সেরামে ভিটামিন ডি রয়েছে ৩০ ন্যানোমোল/লিটার। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেরামে ভিটামিন ডি-এর মাত্রা কমে গেলেই নানা রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে। ফলে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যায়। কোভিড আক্রান্ত দেশগুলিতে পরীক্ষা চালিয়েই এই প্রমাণ মিলেছে।