ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাংলাদেশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার মন কাড়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ ও মিনার, নদী, পাহাড়, অরণ্যসহ হাজারও সুন্দরের রেশ ছড়িয়ে আছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত।
দেশের আট বিভাগে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ) ৬৪ জেলা। প্রতিটি জেলার নামকরণের সঙ্গে রয়েছে ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাস। এসব ঘটনা ভ্রমণপিপাসু উৎসুক মনকে আকর্ষিত করে তোলে। তাই বাংলা ট্রিবিউন জার্নিতে ধারাবাহিকভাবে জানানো হচ্ছে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার নামকরণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। রংপুর জেলা দেশের উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জনপদ। সুপ্রাচীনকাল থেকে এই জেলার রয়েছে গৌরবময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাস। এর প্রায় ৮০ শতাংশ তিস্তার প্লাবন ভূমি ও ২০ শতাংশ বরেন্দ্রভূমির অন্তর্গত। এই অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিস্তা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, আখিরা ও করতোয়া নদী। ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি রংপুরকে দেশের সপ্তম বিভাগ হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
প্রচলিত ধারণা থেকে জানা যায়, রংপুর জেলার পূর্বনাম ‘রঙ্গপুর’। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, রংপুরের নামকরণের ক্ষেত্রে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজীর অবদান গ্রহণযোগ্য। ‘রঙ্গপুর’ শব্দটি ফারসি শব্দ। তাই সঙ্গত কারণে বখতিয়ার শাসনামলেই রংপুরের নাম ‘রঙ্গপুর’ হয়েছে। রংপুর নামকরণের ক্ষেত্রে লোকমুখে প্রচলিত আছে, ‘রঙ্গপুর’ থেকেই কালক্রমে এই নামটি এসেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলের মাটি উর্বর হওয়ায় ইংরেজরা এখানে নীলের চাষ শুরু করে। ওই নীলকে স্থানীয়রা ‘রঙ্গ’ নামেই জানতো। কালের বিবর্তনে সেই রঙ্গ থেকে ‘রঙ্গপুর’ ও পরে তা রূপ নেয় ‘রংপুর’।
কেউ কেউ মনে করেন, মহাভারতের সময় প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজাভগদত্তের রঙমহল ছিল রংপুরে। সেই রঙমহল থেকে ‘রঙ্গপুর’ নামটি এসেছে। কারও মতে, ভগদত্তের কন্যা পায়রাবতীর নামানুসারে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি পায়রাবন্দের নামকরণ হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, রংপুরে বস্ত্ররঞ্জনী কারখানা ছিল। পাট নির্মিত বস্ত্রে বা চটে রঙ করা হতো বলে রংপুরকে বলা হতো ‘রংরেজপুর’। এর পরিবর্তে হয়েছে রঙ্গপুর (রংপুর)। রংপুর জেলার আরেক নাম ‘জঙ্গপুর’। সুদূর অতীত থেকে আন্দোলন প্রতিরোধের মূল ঘাঁটি ছিল রংপুর জেলা। তাই রংপুরের আদি নাম হিসেবে ধরা হয় ‘জঙ্গপুর’। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ, পুর অর্থ নগর বা শহর। ইংরেজদের অত্যাচারে সুদূর অতীতে রংপুর জেলা ছিল রণভূমি। ত্রিশের দশকের শেষ ভাগে এ জেলায় কৃষক আন্দোলন বিকাশ লাভ করায় রংপুরকে লাল রংপুর হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব থাকায় কেউ কেউ এই জেলাকে ‘যমপুর’ বলেও ডাকতো। রংপুরের দর্শনীয় স্থানের তালিকায় রয়েছে রংপুর জাদুঘর, রংপুর চিড়িয়াখানা, রংপুর টাউন হল, পায়রা চত্বর, কারমাইকেল কলেজ ভবন, জেলা পরিষদ ভবন, পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র, ভিন্নজগৎ, শিরীন পার্ক, আনন্দনগর, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ, পীরগঞ্জের ঝাড়বিশলায় কবি হেয়াত মামুদের সমাধি, চিকলির বিল, শাশ্বত বাংলা (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর), পীরগঞ্জ উপজেলায় ড. ওয়াজেদ মিয়ার তোরণ, ভাস্কর্য অর্জন, স্মৃতিস্তম্ভ রক্তগৌরব, বেনারসী পল্লী। প্রাচীন নিদর্শনগুলো হলো মন্থনার জমিদার বাড়ি, তাজহাট জমিদার বাড়ি, রায়পুর জমিদার বাড়ি, দেওয়ানবাড়ির জমিদার বাড়ি, পায়রাবন্দ জমিদার বাড়ি, মন্থনার জমিদার বাড়ি, পীরগাছা দেবী চৌধুরাণীর রাজবাড়ি, ইটাকুমারীর জমিদার শিবচন্দ্র রায়ের রাজবাড়ি, লালদীঘির নয় গম্বুজ মসজিদ, কেরামতিয়া মসজিদ, মাহিগঞ্জের কাজিটারী মসজিদ, মিঠাপুকুর তিন কাতারের মসজিদ, ফুলচৌকি মসজিদ, মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর (রহ.) মাজার ও মসজিদ, হযরত শাহজালাল বোখারীর মাজার, হাতীবান্ধা মাজার শরীফ, কেরামতিয়া মসজিদ ও মাজার, কুতুব শাহের মাজার, পাটগ্রামে রাজা নীলাম্বরের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ, লালদীঘি মন্দির, চন্দনহাট হরি মন্দির, ডিমলা রাজ কালী মন্দির ও মোগল আমলে খনন করা মিঠাপুকুর, কাউনিয়ার আনন্দমঠ।
বাংলাদেশের যত প্রাচীন পৌরসভা আছে তার মধ্যে রংপুর শহর একটি। রংপুর শহর হল রংপুর বিভাগের অন্যতম প্রধান শহর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এই শহরে রয়েছে দর্শনীয় অনেক স্থান। এছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসক এখানে শাসন করেছেন। আমাদের আজকের এই প্রবন্ধটি রংপুরের ইতিহাস নিয়ে লেখা। আসুন জেনে নেই রংপুরের আদি ইতিহাস।
রংপুর এর নাম রংপুর কিভাবে হল তা নিয়ে অনেক অনেক মতবাদ প্রচলিত। অনেকেই বলে রঙ্গপুর থেকেই রংপুর শব্দের উৎপত্তি। এর পিছনে যে ইতিহাস আছে তা হল কামরূপ সাম্রাজ্জে ভগদত্ত নামে একজন রাজা ছিলেন। তিনি এক রঙ্গমহল বানান নদীর তীরে। রঙ্গমহল বলতে প্রাচীন কালে রাজা জমিদারগণ অবসর সময়ে নাচ গানের আসর বসানোর জন্য আলাদা বাড়ি বানাতেন। সেখানে তাঁরা অবসরে যেয়ে আনন্দ করতেন। এই রঙ্গমহল থেকে ক্রমে নাম হয় রঙ্গপুর। রঙ্গ মানে আনন্দ, খুশি আর পুর মানে জায়গা। মানে খুশির জায়গা হল রঙ্গপুর। পরে তার নাম হয় রংপুর। আরেকদল মনে করে যখন ইংরেজরা নীল চাষ শুরু করে, তখন রংপুরেও এর প্রভাব দেখা দেয়। এই অঞ্চলের মাটি অনেক উর্বর হয়। তাই প্রচুর পরিমানে নীল চাষ হত এই এলাকায়। এই নীলকে স্থানীয় লোকেরা রঙ্গ বলত। এই রঙ্গ থেকেই রংপুর নাম শুরু। অনেকের মতে এই এলাকায় চট বস্ত্রকে রঙ করা হত, সেখান থেকেও নাম রংপুর হয়েছে। কিছু ইতিহাসবিদ বলেন রঙ্গপুর ফার্সি শব্দ আর এই নাম এসেছে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির থেকে। আবার ম্যালেরিয়া রোগের অনেকবেশি প্রভাব ছিল এই এলাকায়। এজন্য অনেকেই একে যমপুর বলত। সেই যমপুর থেকে আসে জঙ্গপুর। এটি রংপুর জেলার আরেক নাম। আবার জঙ্গ মানে যুদ্ধ। যেহেতু এই এলাকায় সব সময় আন্দোলন হত এবং ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে, ত্রিশ দশকের শেষে কৃষক আন্দোলন সব কিছুতে রংপুরের নাম জড়িত।
রংপুর অনেক প্রাচীনকাল থেকেই সুপরিচিত। কামরূপ সাম্রাজ্যের সময় থেকে এর নাম পাওয়া যায়। চতুর্থ শতাব্দির সময় এই এলাকা বর্মা রাজবংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর পালবংশ, সেনবংশ এখানে রাজত্ব করে। এরপর রংপুর মোঘলদের হাতে আসে ১৫৭৫ সালে। মোঘল সেনাপতি মান সিংহ রংপুর আক্রমন করে এবং জয়লাভ করেন। ঘোরাঘাট সরকার ও রংপুরের দখল নেয়। পরে ইংরেজরা ১৭৬৫ সালে এখানে আসে। তখন হয় কৃষক বিদ্রোহ। এরপর ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলে তার রেশ এখানেও এসেছিল। এখনাকার ইংরেজ শাসকরা বেশ ভয় পেয়েছিল। এখানে ফকির বিদ্রোহও হয়েছিল। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন এখানে শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে হয় কৃষকদের নিয়ে তেভাগা আন্দোলন।
রংপুরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ। তিনজন শহীদ হন। প্রথম শহীদ হলেন শঙ্কু সমজদার । এরপর রংপুরের অনেক মানুষ যুদ্ধ করতে আসে এবং এখানে অনেক গণকবর পাওয়া গেছে।
রংপুরে অনেক তামাক উৎপন্ন হয়। ধান, পাট, আলু, হাড়িভাঙ্গা আম ইত্যাদির জন্য রংপুর বিখ্যাত। এছাড়া রংপুর অঞ্চলে কয়লা ও তামা পাওয়া গেছে। রংপুরের আশ পাশ দিয়ে তিস্তা নদী, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, যমুনা, ধরলা ইত্যাদি নদী প্রবাহিত হয়েছে। রংপুরের ৮০ ভাগ এলাকা হল তিস্তার প্লাবন ভূমি। আর ২০ ভাগ এলাকা হল বরেন্দ্র ভূমি।
রংপুরে রংপুর মেডিকেল কলেজ, রংপুর ডেন্টাল কলেজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর জিলা স্কুল, রংপুর ক্যাডেট কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, রংপুর উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি ভাল ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এছাড়া আছে বিভিন্ন পার্ক, জমিদারবাড়ি, পিকনিক স্পট।
হেয়াত মাহমুদ মধ্যযুগের কবি, বেগম রোকেয়া, আনিসুল হক, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, রফিকুল হক, মাহবুব আলম প্রমুখ রংপুরের বিখ্যাত ব্যাক্তি।
রংপুর আমাদের অনেক ঐতিহ্যবাহী একটি এলাকা। অনেক ইতিহাস আছে এই এলাকা নিয়ে। রংপুর বাংলাদেশেরও গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল।