1. tanvirinternational2727@gmail.com : NewsDesk :
  2. hrbangladeshbulletin@gmail.com : News Room : News Room
  3. 25.sanowar@gmail.com : Sanowar Hossain : Sanowar Hossain
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৮:৫৫ অপরাহ্ন

দ্বিতীয় পর্ব—একজন ফজলুল হক মনিঃ বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী

  • সময় : শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০
  • ৯০৭

শেখ ফজলুল হক মনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন – তা সকলের জানা। তাঁকে বহু বিশেষণে সংজ্ঞায়িত করার পূর্বে তাঁর উচ্চমার্গীয় দর্শন ও ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা সর্বাগ্রে বিশ্লেষণ করা বেশি প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

স্বাধীনতা পরবর্তী ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ ভাবনায় তিনি কাতর হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি সতর্ক করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সর্বজনের প্রতি বিশ্বাসের ভিত টলাতে না পেরে ‘বাংলার বাণী’তে (১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২) লিখেছিলেন –


“‘বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই একটি রাষ্ট্র। মানুষ এখানে দরিদ্র। মধ্যবিত্তের উচ্চাভিলাষ এখানে অপরিমিত, স্বাধীনতার শত্রুরা এখানে তৎপর, পুরাতন আমলারা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রে পুনর্বাসিত। সুতরাং সময় থাকতে রোগ ধরা না গেলে দাওয়াইটিও কেউ খুঁজবে না এবং একজন সংবাদপত্রসেবী হিসেবে সে দায়িত্ব আমাদেরই।’

এই উদ্ধৃতির আক্ষরিক বাস্তবতা আমরা ’৭৫ পরবর্তী কালে দেখেছি।

শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাংবাদিক, কলাম লেখক, ছোট গল্পকার, তাত্ত্বিক দার্শনিক ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দ্রষ্টা।

বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগম (শেখ মনির মা) স্বামীর চাকরিসূত্রে কলকাতায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধু কলকাতায় থাকা কালীন সময়ে অধিকাংশ সময় এই বোনের বাড়িতে থাকতেন।

কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর অভিভাবক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এই আছিয়া বেগম এবং তাঁর স্বামী।

সক্রিয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু সব সময় পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা পেতেন। বঙ্গবন্ধুর চার বোন – এক ভাই ছিলেন একই বোধের, পরম আস্থার।

শেখ ফজলুল হক মনি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগমের বড় ছেলে, বঙ্গবন্ধুর আদরের ভাগ্নে।

শেখ মনি’কে বঙ্গবন্ধু বোনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন। বোনকে তিনি বলেছিলেন – “বুঁজি তোমার মনিকে আমারে দাও, ও রাজনীতি করুক।”

শেখ আছিয়া বেগম বলেন- “তুমি রাজনীতি করো তাতেই আমরা পুরো পরিবার উৎকন্ঠায় থাকি।”

বঙ্গবন্ধু – “বুঁজি রাজনীতিতে আমার তো কেউ ছিলো না, মনি’র তো আমি আছি।”

এরপর বোন আর তাঁকে না করতে পারেন নাই।

মাত্র ৩৫ বছর বয়সের ক্ষণজন্মা শেখ মনি ছিলেন- মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান, দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, কবি ও ছোট গল্পকার।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাগ্নেকে রক্ষা করতে পারেন নাই। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মনি তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শেখ আরজু মনিসহ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলেন।

১৪ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর বোন – শেখ ফজলুল হক মনির মা রাত বারোটা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছিলেন।

গল্প করেছেন ভাই ও ভাই পত্নীর সাথে। একান্তে সময় দিয়েছেন নিষ্পাপ রাসেলসহ সবার সাথে।

শেখ আছিয়া বেগম জানতেন না সেই রাতে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, ছোট ভাই শেখ নাসের, ছেলে, ছেলের বউ, ভাতিজাদের হারাবেন।

মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সবাইকে হারিয়ে তিনি পাথর হয়ে গেলেন।

পরবর্তীতে শেখ আছিয়া বেগমের সীমাহীন কষ্ট ও আতঙ্কের মাধ্যমে দীর্ঘ পথ চলা শুরু হয়।

শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি ও শহীদ আরজু মনির দুই ছেলে অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশ ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস হৃদয়বিদারক ১৫ আগস্টের কালো রাত স্বচক্ষে দেখেছেন।
বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো প্রতিদিন মৃত্যুর কবলে পড়ে আবার বেঁচেছেন।
ইতিহাসের জঘন্য সেই হত্যাকাণ্ড গা শিউরে উঠা ঘটনা শেখ পরশের জবানীতে –

“খুব ভোরে প্রচণ্ড ভাঙচুরের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি মা নেই পাশে। বিছানায় শুধু আমরা দুই ভাই। জানালা দিয়ে ঝড়ের মতো গোলাগুলি হচ্ছে। গুলিগুলো দেয়াল ফুটো করে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। সিঁড়িঘরে অনেক কান্নাকাটির আওয়াজ, হৈচৈ।


আমরা দুই ভাই ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়িঘরের দিকে গিয়ে দেখি বাবা-মা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়া। মা’র পা দুটো বাবার বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা। দাদির শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি যাছে, আর দাদি পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন; দেয়ালে কপাল ঠুকছেন।

এ অবস্থায় উনি আমার বড় চাচীকে বললেন, “ফাতু, আরজুর পা দুটি মণির বুকের ওপর থেকে সরাও।”

সেলিম কাকা আর চাচী বাবা-মা’র পাশে মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছেন। আর বাবা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নাই। মনে হচ্ছে উনি যেন শান্তির নিদ্রায় বিভোর। শুধু গলায় কণ্ঠমণির নিচে চামড়া উঠে যাওয়ার একটা চিহ্ন। বাবার শরীরের অন্য কোথাও কোনো ক্ষত আমার মনে নাই।

আমরা দুই ভাই কান্নাকাটি করছিলাম। মনে হয় আমরা ভয়েই কাঁদছিলাম; কারণ মৃত্যু কাকে বলে তখনো আমরা জানি না। মৃত্যুর পর যে মানুষকে আর পাওয়া যায় না, সেটাও আমার জানা ছিল না। মৃত্যুর সাথে ওই আমার প্রথম পরিচয়। একসাথে অনেকগুলো মৃত্যু।

মা’র মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সাথে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ।

মা চাচীকে বললেন, “ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।”

ওটাই বোধহয় মা’র শেষ কথা। এরপর কি হলো আমি জানি না। গুলির আওয়াজ অনেক বেড়ে যাচ্ছিল এবং কারা যেন এদিকে আবার আসছিল। আমার চাচী তখন আমাদের নিয়ে তার ড্রেসিংরুমে পালালেন। আমাদের মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিলেন যাতে গুলি না লাগে। গুলি মনে হয় বাথরুমের জানালা দিয়ে ড্রেসিংরুমেও ঢুকে যাচ্ছিল।

এরপর আর বাবা-মা’র সাথে আমাদের আর দেখা হয় নাই। শুনেছি সেলিম কাকা একটা গাড়িতে করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। আর মারুফ কাকা অন্য একটা গাড়িতে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

এরপর সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুই ভাই, চাচী, দাদি, আর রেখা ফুফু এক কাপড়ে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে যাই। তখনো বুঝি নাই যে ওটাই নিজেদের বাসা থেকে আমাদের শেষ প্রস্থান। আর কখনো ঐ বাসায় ফিরতে পারব না।

আমার বয়স তখন পাঁচ বছর, আর আমার ভাই, তাপসের বয়স চার বছর। আমাদের বাসাটা ছিল ধানমন্ডি ১৩নং রোডে একটা কানাগলির রাস্তায়। বাসা থেকে বের হয়ে পাশেই ছিল একটা বিদেশি রাষ্ট্রদূত ভবন। আমরা সেখানেই আশ্রয় নেই। ওখান থেকে আমরা দেখতে পাই আমাদের বাসায় আর্মিদের আনাগোনা, লুটতরাজ।

এরপর শুরু হয় আমাদের ভবঘুরে জীবনযাপন; একেক দিন একেক বাসায়।

কোনো বাসায় দুই দিন, কোনো বাসায় চার দিন। আশ্রয়ার্থী হিসেবে এভাবেই চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কেন আমরা নিজের বাসায় ফেরত যেতে পারছি না। পরে দাদি-চাচীদের মাধ্যমে বুঝলাম যে আর্মিরা আমাদের খুঁজছিল।

কয়েকটা বাসায় আর্মিরা আমাদের খুঁজতেও এসেছিল। ভাগ্যিস আমরা সময়মতো সেই বাসা থেকে পালিয়ে অন্য বাসায় আশ্রয় নিয়েছি।

মাহুতটুলিতে মঞ্জু খালার বাসায় আমরা মনে হয় বেশ কিছুদিন ছিলাম। মঞ্জু খালা আমাদের পেয়ে অস্থির! আদর-যত্মেই ছিলাম, কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে ও বাসায়ও শান্তিতে থাকতে পারি নাই। চলে আসার সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্জু খালা ভীষণ কেঁদেছিলেন। তখনো জানতাম না ঐ কান্নার আড়ালে অন্তর্নিহিত কারণ।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মঞ্জু খালাও ১৫ আগস্টে তার বাবা (আবদুর রব সেরনিয়াবাত), দুই বোন (আমার মা ও বেবি খালা), ভাই (আরিফ মামা) এবং চার বছরের ভাতিজাকে (সুকান্ত বাবু) হারিয়েছে। তারপর আবার আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাওয়াই তো ওনাদের জন্য প্রচণ্ড মানসিক চাপ ছিল।

আমার চাচীর আব্বা, মরহুম সুলতান আহমেদ চৌধুরীর বাসায়ও আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। এবং সেই বাসায় আর্মিরা রেইডও করেছিল। চাচীর বড়বোন, আনু খালার পাঁচ বছর বয়েসি সন্তান লিমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিল।

পরে অনেক কসরত করে এবং ধস্তাধস্তি করে লিমাকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় ওর বাবা আজাদ আঙ্কেল। চাচীর মেজোভাই, বাচ্চু মামাকেও আর্মিরা তুলে নিয়ে যায়। বাচ্চু মামা সেলিম কাকা মারুফ কাকাদের সীমানা পার করে দিয়ে আসার পরেই তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় কর্নেল শাহরিয়ার। আর তাকে পাওয়া যায় নাই। এমনকি তার লাশটাও ওরা ফেরত দেয় নাই।

সবাই তখন সারাক্ষণ শুধু কাঁদত। কারও সন্তান হারানোর ব্যথা, কারও ভাই-বোন হারানোর কষ্ট, আর আমাদের বাবা-মা হারানোর অন্তহীন কান্না। তবে কেউ কারও সামনে কাঁদতে পারত না। আড়ালে গিয়ে বোবাকান্না কাঁদত। আমাদের সামনে সবাই কান্না আড়াল করে ফেলত। কারণ তখনো আমদের বলা হয় নাই যে আমাদের বাবা-মা আর নেই। এভাবেই জীবননাশের হুমকি আর ভয়ভীতিকে সঙ্গী করে আমাদের শোকাহত পরিবারের জীবনের গাড়ি চলতে থাকে।

সেলিম কাকা আর মারুফ কাকার জীবনে তখন চরম ঝুঁকি। মারুফ কাকা তখন খুনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কাদের সিদ্দিকী বাহিনীতে যোগ দিতে মেঘালয় চলে যান। সেলিম কাকাকে তো গুলিই করা হয়েছিল। অল্পের জন্য অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। শুনেছি খুনিরা যখন বাবাকে মারতে আসে, চাচী সেলিম কাকাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খবর দেন।

সেলিম কাকা হুড়মুড় করে গিয়ে দেখে ওরা বন্দুক তাঁক করে আছে বাবার দিকে। সেলিম কাকা ওদের ধাক্কা দিলে ওরাও তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়িঘরের কোণায় ফেলে দেয়।

ঠিক তখনই ওরা গুলি করা শুরু করে। রুমের কোণায় এবং নিচে পড়েছিলেন বলে হয়তোবা গুলি তাঁর গায়ে লাগে নাই। ঐ মুহূর্তে মা তখন রুম থেকে বের হয়ে এসে বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। আমার মা মনে হয় বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন।

তাই প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই মা বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে তিনি আমাদের কথাও ভাবেন নাই।

মা স্বামীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ রেখে গেছেন। হয়তোবা গুলি লাগার পরে তার আমাদের দুই ভাইয়ের কথা মনে হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার আর উপায় ছিল না।

১৫ আগস্টের পরে অনেকে আমাদের আশ্রয় দিতে ভয় পেতেন। আবার অনেকে জীবনের অনেক ঝুঁকি নিয়েও, আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সবার কথা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না বলে আমি দুঃখিত। তবে তখন আমদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইত না। কয়েক মাস পরে অনেক কষ্টে রেবা ফুফু (মেজোফুফু) আরামবাগে আমাদের জন্য একটা বাসা ভাড়া নেয়। ঐ বাসায় আমরা কয়েক মাস থাকি।”

উল্লেখ্য, শেখ মনির বেঁচে যাওয়া দুই ছেলে, শেখ ফজলে শামস পরশ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ এর চেয়ারম্যান ও শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র।

শোকাবহ ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ফজলুল হক মনির ছেলে তাপস বলেন, “অন্যদের বাবা-মায়ের কত স্মৃতি। আমারও তো ইচ্ছে করে অন্যদের মতো বাবা-মায়ের স্মৃতিচারণ করতে।”

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ তাপস আরো বলেন –
“১৫ আগস্ট ১৯৭৫
তখনও আমার বয়স চার বছর পূর্ণ হয়নি!

সারাদিন মা-এর সাথে লেগে থাকতাম। তাঁর পিছনে পিছনে। একটু চোখের আড়াল হতে দিতাম না। মা বাথরুমে গেলেও বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকতাম আর দরজা ধাক্কাতাম
কখন মা বেরিয়ে আসবে..

আমার মা শামসুন্নেছা আরজু মনি। স্বামীকে বাঁচাতে ঢাল হয়ে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঘাতকের নির্মম বুলেট নিয়েছেন নিজের বুকে ও পেটে। পারেননি তবুও স্বামীকে বাঁচাতে। অন্তঃস্বত্ত্বা অবস্থাতেই উৎসর্গ করেছেন তাঁর প্রাণ।

রেখে গেছেন দুই অবুঝ সন্তান- পরশ ও তাপস।

মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সময়ে…
দুই সন্তানের কথা মনে করে নীরবে ফেলেছেন চোখের পানি।

শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের মুহুর্তে পাশে বসা দেবর শেখ ফজলুল করিম সেলিমকে শুধু বলে গেছেন: সেলিম ভাই, – ‘আমার পরশ-তাপসকে দেইখেন!’

দেবর শেখ ফজলুল করিম সেলিম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন ভাবীর সেই শেষ অনুরোধ।

বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে লালন-পালন করেছেন বড় ভাই শেখ ফজলুল হক মনি’র দুই পুত্র সন্তান পরশ ও তাপসকে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।

মায়ের দু’টি গান খুব প্রিয় ছিল এবং দুটি গানই
আমাদের ঘুম পাড়ানোর সময় মা গাইতেন:
০১। পরশ/তাপস সোনা বলি শোন
থাকবে না আর দুঃখ কোন
মানুষ যদি হতে পারো..
০২। ও তোতা পাখিরে, শিকল খুলে উড়িয়ে দিব
আমার মা’কে যদি এনে দিস..
সবাই বলে ওই আকাশে….!

আমার বড় চাচী ফাতেমা সেলিম আমাদের এই দু’টি গান গেয়ে শুনাতেন এবং ঘুম পাড়াতেন। মা এর সব গল্প বলতেন।

দাদা, নানী, খালা ও ফুফুদের কাছ থেকেও
মায়ের সব গল্প শুনেছি।

শুনেছি গল্প (ফুফু) বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা থেকে; পিতা-মাতা হারানোর ব্যাথা যারা
রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুধাবন করে..

মা….!


মা এর স্মৃতি বলতে কয়েক সেকেন্ডের কম হবে
এমন একটি মুহূর্ত আবছা আবছা মনে পড়ে..

আমার মা মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার জন্য কিছুদিন নানা আবদুর রব সেরনিয়াবাত-এর বাসায় গিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।

সেই সময়ের কোন একদিন মা পড়ছিল, আর আমি আরিফ মামার সাথে খেলছিলাম। আরিফ মামা আমাকে ধরতে আসছিল।

আর আমি মা এর কাছে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। এ রকম একটি মুহূর্তে আরিফ মামা
আমাকে ধরতে আসলো, আর আমি মা-এর কাছে দৌড়ে গেলাম।

…মা পড়ার টেবিলে মনোযোগ দিয়ে পড়া মুখস্ত করছিল! শুধু মনে পড়ে: আমি দৌড়ে মা’র চেয়ার ধরলাম আর মা হাসি মুখে আমার দিকে তাকালো।

আজও স্বপ্নের মতো লাগে আমার কাছে সেই মুহূর্তটা!
আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মূহুর্ত!

আমার সবচেয়ে বড় কস্ট-
মা এর আর কোন স্মৃতি নেই আমার কাছে।

আমি মনে করতে পারি না…
মা এর হাসি ভরা মুখ, তাঁর আদর আলিঙ্গন।
তাঁর ভালোবাসা, তাঁর রাগ, দুঃখ-কান্না।

মনে করতে পারি না-

  • আমাকে গান গেয়ে ঘুম পাড়ানো।
  • আমাকে গোসল করানো।
  • আমাকে পড়তে বসানো।
  • আমাকে কোলে নিয়ে চুল আঁচড়ানো।

চার বছরের সেই অবুঝ ছেলেটি আজও
খুঁজে ফিরছি মা এর স্মৃতি
মা এর হাসি, আদর, আলিঙ্গন, ভালবাসা।

অবুঝ বয়সেই বুঝতে পেরেছি-
আর পাব না!
মা’কে-ও না
তাঁর স্মৃতিও না
জেনেছি কঠিন সত্য; জীবনে চাইলেই
সব কিছু পাওয়া যায় না!

বুকের মধ্যে কষ্ট সহ্য করতে শিখেছি। কেঁদেছি নীরবে ডুকরে ডুকরে। জানতে দেইনি কখনোই কাউকে।

অনেকে বলে স্মৃতি তুমি বেদনার!
আমি বলি, স্মৃতি না থাকার বেদনা কত কষ্টের!

আমাকে একটু আমার মায়ের স্মৃতি দাও,
আমি তা-ই নিয়ে বেঁচে থাকি।”

চলবে…


এ্যাডভোকেট শেখ নবীরুজ্জামান বাবু
বৃত্তিপ্রাপ্ত পিএইচডি গবেষক (ঢাবি)
সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ
সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
.

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের অন্যান্য খবর
©বাংলাদেশবুলেটিন২৪