রাকিব হাসান-
দেশের জনপ্রিয় দুটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও নগদ। দেশের আনাচে কানাচে এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে ১০ টাকা থেকে শুরু করে একজন গ্রাহকে প্রতিদিন ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেনের সুবিধা দেয় কোম্পানি গুলো। গ্রাহক সেবার মান বাড়াতে এসব কোম্পানি বিভিন্ন ভার্ষনে এ্যাপস তৈরি করে থাকে এবং এসব একাউন্টের নিরাপত্তার বিষয়টিও তারা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সম্প্রতি পুলিশের বিশেষায়িত ফোর্স র্যাবের অভিযানে উঠে এসেছে ভয়ংকর তথ্য। আর তা হলো চীনা পেইড এ্যাপসের মাধ্যমে বিকাশ/নগদ আইডি মুহুর্তেই ক্লোন করতে পারছে আপরাধী চক্র।
র্যাব বলছে, প্রতারণার মাধ্যমে অপরাধী চক্রের এসব সদস্যরা ক্লোন করা এ্যাকাউন্ট থেকে মুহুর্তের মধ্যেই ব্যবহার কারীর টাকা সরিয়ে নেয়। চক্রটি প্রতারনার জন্য বিভিন্ন ওয়েব সাইট থেকে মোবাইল এ্যাপস এবং ফোন নাম্বার ক্লোন করার এ্যাপস কিনে নেয়। পরবর্তীতে ব্যবহারকারী বাংলাদেশের সহজ সরল নাগরিকদের কাছ থেকে সুকৌশলে প্রতারনার মাধ্যমে বিকাশ এ্যাকান্টের কন্ট্রোল নিয়ে নিজেদের মোবাইলে ক্লোন এ্যাপস ব্যবহার করে তাদের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে।
গত (২ এপ্রিল) রাতভর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা এবং ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুটি প্রতারক চক্রের ৯ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব-১০।
এ বিষয়ে র্যাব -১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, প্রতারক চক্র দুটি শিক্ষাবৃত্তি, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা প্রদান এবং বিকাশ/নগদের এজেন্টদের এ্যাপস/নাম্বার ক্লোন করে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে। চক্র দুটি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সাথে প্রতারনা করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এমন একজন ভুক্তভোগী কক্সবাজার জেলার পেকুয়া এলাকার বাসিন্দা ইসতাহাদ উদ্দিন সোহান (১৯)। সে গত ২২ মার্চ বেলা ৩.৩৬ মিনিটে একটি কল পান। অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয় “আমি মন্ত্রনালয় থেকে বলছি, আপনার নাম্বারে উপবৃত্তির টাকা পাঠানো হবে। আপনার এ্যাকাউন্ট সেটিংসে কিছু সমস্যার কারনে টাকা পাঠানো যাচ্ছে না। অনুগ্রহ করে আপনি কিছু তথ্য দিয়ে আমাদের সহায়তা করুন। এরপর সুকৌশলে তার বিকাশের পিন নাম্বার নিয়ে নেয় চক্রটি। পরবর্তীতে সর্বমোট ৩৮,২৫৮/- (আটত্রিশ হাজার দুইশত আটান্ন) টাকা তার একাউন্ট থেকে মুহুর্তেই সরিয়ে ফেলা হলে, সে কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানায় একটি সাধারন ডায়েরী করে। এছাড়াও গত ২৪ মার্চ একই এলাকার জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক শিক্ষাথীর কাছ একই প্রতারক চক্র ২০,৪০০/- (বিশ হাজার চারশত) টাকা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানা এলাকার লোকমান হোসেন (৪৪) এর কাছ থেকে তার ছেলের নামে উপবৃত্তির কথা বলে ১৬৩০০/- (ষোল হাজার তিনশত) টাকা প্রতারনা করে হাতিয়ে নেয়।
অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদ উদ্দিন জানান, চক্রটির সন্ধানে র্যাব-১০ রাজধানীর বিভিন্ন এালাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের মূল হোতা ইসমাইল মাতুব্বর (২১), ইব্রাহীম মাতুব্বর (২৭), মোঃ মানিক ওরফে মতিউর রহমান (১৯) এবং মোঃ সিনবাদ হোসেন (২৪) নামের ৪ জনকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২২টি মোবাইল ফোন, ৩৫টি সিম কার্ড, ৫টি মোবাইলের চার্জার, ১টি ল্যাপটপ, ১টি ব্যাগ ও নগদ-৩০,০০০/- (ত্রিশ হাজার) টাকা উদ্ধার করা হয়।
এই চক্রের সন্ধান করতে গিয়ে র্যাব-১০ এর গোয়েন্দারা আরও একটি চক্রের সন্ধান পায়। চক্রটি বিকাশ/নগদের বিভিন্ন এজেন্টের এ্যাপস ক্লোন করে মুহুর্তেই এজেন্টের এ্যাকাউন্টে থাকা টাকা সরিয়ে ফেলত।
এই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েছিলেন আব্দুল মমিন (৪২) নামক একজন নতুন বিকাশ এজেন্ট। সে গত ১৩ ফেব্রুয়ারী একই উপায়ে ফোন কল পান। চক্রটি তার এজেন্ট সীমে থাকা ৪২,৭৭৭/-( বিয়াল্লিশ হাজার সাতশত সাতাত্তুর) টাকা হাতিয়ে নেয়।
পরবর্তীতে তিনি এ সংক্রান্তে থানায় জিডি করেন। ওই জিডির সূত্র ধরে র্যাব-১০ এর দুইটি আভিযানিক দল ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলার ভাংগা এলাকায় অপর দুইটি অভিযান পরিচালনা করে চক্রের অন্যতম মূল হোতা মোঃ সুমন ইসলাম (২০), মাহমুদুল হাসান পলক (২০), সাব্বির খন্দকার (১৯), মোঃ সাকিব (১৯) এবং রাসেল তালুকদার (২৩) কে গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের নিকট থেকে প্রতারনার কাজে ব্যবহৃত ১৪টি মোবাইল ফোন, ৯১টি সিম কার্ড, ০১টি ব্যাগ, ১০৪টি ইয়াবা ট্যাবলে ও নগদ-৫২,৫০০/- (বায়ান্ন হাজার পাঁচশত) টাকা উদ্ধার করে র্যাব।
র্যাব সূ্ত্রে জানা যায়, চক্র দুটির প্রতারনার কৌশল অভিন্ন। একটি চক্র মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) ব্যবসায় অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এজেন্টদের অর্থ আত্মসাৎ করত। তারা প্রায় ৮-৯ মাস যাবৎ এ ধরনের প্রতারনা করে আসছিল। অপর চক্রটি শিক্ষাবৃত্তি/ বয়স্কভাতা/ বিধবাভাতা প্রদানের নামে প্রতারনা করে গ্রাহকের এ্যাকাউন্টের টাকা হাতিয়ে নিত। তারা দুই বছর যাবৎ এসব কাজ করছিল। প্রতারনার মাধ্যমে চক্রটি ২০-২৫ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে।
একটি চক্র প্রতারনার কৌশলগত কারনে নিরিবিলি স্থান হিসেবে দক্ষিণ কেরাণীগনঞ্জ এলাকায় বেছে নেয় যাতে নির্বিঘ্নে প্রতারণার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। তারা প্রথমে সরকারী উপবৃত্তির ওয়েবসাইট থেকে উপবৃত্তির তালিকা সংগ্রহ করতো। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত আসামী ইসমাইল প্রথমে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে ক্লোন করে বিকাশ/নগদ একাউন্ট খোলা ভিকটিমদের বিভিন্ন মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে নিজেকে শিক্ষা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদানের কথা বলে প্রলুব্ধ করে। অতঃপর বিশেষ মোবাইল অ্যাপসের সহায়তায় ভিকটিমদের মোবাইলে ফোন করে সিরিয়াল নম্বরের কথা বলে অথবা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বিকাশ/নগদের ওটিপি সংগ্রহ করত। ওই ওটিপির মাধ্যমে তারা ভিকটিমদের বিকাশ/নগদ একাউন্ট হ্যাক করে অন্য একাউন্টে স্থানান্তর করার মাধ্যমে ভিকটিমদের টাকা আত্মসাৎ করত। একইভাবে তারা একাধিক ভিকটিমের বিকাশ/নগদ একাউন্টের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে রাখতো এবং একটি মোবাইলে একাধিক বিকাশ/নগদ অ্যাপস ডাউনলোড করে একাউন্টে লগইন করে রাখতো। পরবর্তীতে ওই একাউন্টে কোনো টাকা প্রবেশ করা মাত্র ইসমাইল মোবাইলে নটিফিকেশনের মাধ্যমে তা জানতে পারে এবং সাথে সাথে টাকাগুলো তার অন্যান্য সহযোগী ইব্রাহীম, মানিক ও সিনবাদের একাউন্টে স্থানান্তর করে। পরবর্তীতে সিনবাদ টাকা গুলো তাদের আশপাশের অথবা দূরবর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্যাশআউট করে ইসমাইলের কাছে নিয়ে আসতো। প্রতারনার মাধ্যমে অর্জিত টাকা তারা সবাই মিলে ভাগ করে নিত। পরবর্তীতে এই টাকা দিয়ে তারা মাদক ব্যবসা পরিচালনা সহ বিভিন্ন স্থানে সম্পত্তি কিনে রেখে দিত। স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আশায় তারা এই প্রতারণার আশ্রয় নেয়।
গ্রেফতারকৃত অপর চক্রটির মূলহোতা মোঃ সুমন ইসলাম সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধ উপায়ে নতুন এজেন্টদের নাম্বার সংগ্রহ করতো। সুমন প্রথমে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে বিকাশ/নগদের প্রতিনিধিদের নম্বর ক্লোন করে বিভিন্ন বিকাশ/নগদ এজেন্টদের ফোন দিয়ে নিজেকে বিকাশ/নগদের প্রতিনিধির পরিচয় দিত। তারা প্রতিদিন গড়ে ২০ টা নাম্বারে কল দিতো। অতঃপর বিকাশ/নগদ এজেন্টদেরকে হাজারে ৪ টাকার পরিবর্তে ৮-১০ টাকা লাভ করার বিভিন্ন অফার সম্পর্কে অবহিত করতো। এক্ষেত্রে এজেন্টরা উক্ত অফার সম্পর্কে অবগত নয় বললে সুমন এজেন্টদের নিকট হতে বিকাশ/নগদের এসআরের ফোন নম্বর নিয়ে ক্লোন করে উক্ত নম্বর হতে এজেন্টদের ফোন করে সার্ভিস রিপ্রেজেনটেটিভের (এসআর) পরিচয় দিয়ে বলতো উনি আমাদের বস উনি যা বলেন সেভাবে কাজ করেন বলে ফোন কেটে দিত। তারপর সুমন মোবাইলে ওটিপি প্রেরনের মাধ্যমে কৌশলে এজেন্টদের কাছ থেকে বিকাশ/নগদের এজেন্ট নম্বরের পাসওয়ার্ডটি সংগ্রহ করতো। একইভাবে একাধিক এজেন্টের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে একটি মোবাইলে একাধিক বিকাশ/নগদ অ্যাপস ডাউনলোড করে এবং প্রত্যেকটি একাউন্টে লগইন করে রাখতো। ওইসব একাউন্টে কোন টাকা প্রবেশ করা মাত্র সুমন মোবাইলে নটিফিকেশনের মাধ্যমে তা জানতে পারে এবং সাথে সাথে টাকা গুলো তার অন্যান্য সহযোগী মাহমুদুল, সাব্বির, সাকিব ও রাসেলের একাউন্টে স্থানান্তর করে। পরবর্তীতে রাসেল ওই টাকা তাদের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্যাশআউট করে সুমনের কাছে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে টাকা গুলো তারা সবাই মিলে ভাগ করে নিত। এই চক্রটি গত ২ বছর যাবৎ দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৬০-৭০ জন বিকাশ/নগদ এজেন্ট ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। তারা সবাই স্বল্প সময়ে কোটিপতি হবার আশায় এবং মাদক সেবনের অর্থ যোগান দিতে এই প্রতারণার আশ্রয় নেয়।
গ্রাহকদের নিরাপত্তার স্বার্থে র্যাব -১০ অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদ উদ্দিন বলেন, অপরিচিত নাম্বার থেকে কিংবা পরিচিত নাম্বার থেকে হুটহাট কেউ ফোন করে ওটিপি চাইলে তা দেয়া উচিত নয়। এসব চক্র খুবই ভয়ংকর। তারা আমার নাম্বার ক্লোন করেও এ ধরনের প্রতারনার আশ্রয় নিতে পিছপা হবে না। অপরিচিত নাম্বার তো নয়ই পরিচিত নাম্বার হলেও ১০০ ভাগ নিশ্চিত না হয়ে কোন ব্যক্তিগত তথ্য কাউকে শেয়ার না করার অনুরোধ জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।