স্টাফ রিপোর্টার- কম্পিউটারে বিভিন্ন কাজে বেশ পারদর্শী ছিলেন মোঃ আরিফ ব্যাপারী (২০)। সে ঘড়িষাড় ইউনিয়নের বাংলা বাজারে একটি কম্পিউটার দোকানে কাজ করতো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইউটিউব থেকে জালটাকা বানানোর প্রক্রিয়া দেখে এবং নিজের অর্জিত কম্পিউটার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে জাল নোট তৈরিতে পারদর্শিতা অর্জন করে।
র্যাব বলছে, আরিফ তার অপর দুই সহযোগী জাহিদ এবং অনিক এর সহযোগিতায় কম্পিউটার, প্রিন্টার এবং জালটাকা তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজ গৃহে জালটাকা ছাপানোর কাজ শুরু করে।
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়ার চরমোহন এলাকা থেকে জাল টাকা প্রস্তুতকারী চক্রের মূলহোতা আরিফ ব্যাপারী সহ ৩ জন’কে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে.কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বিপুল পরিমান জাল টাকা সহ ৩ আসামীকে গ্রেফতারের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, পবিত্র রমজান ও আসন্ন পবিত্র ঈদ-উল ফিতরকে কেন্দ্ৰ করে বেশকিছু জাল নোট প্রস্তুতকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে র্যাব গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পারে । র্যাব এসব সংঘবদ্ধ জালনোট প্রস্তুতকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে বিশেষ গোয়েন্দা নজরদারী শুরু করে।
তিনি আরও বলেন, গতরাতে র্যাব-৩ এর একটি চৌকষ আভিযানিক দল শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানাধীন ঘড়িষাড় ইউনিয়নের অন্তর্গত চরমোহন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চক্রের ৩ জনকে গ্রেফতার করে।
গ্রফতারকৃতরা হলেন- চক্রের মূলহোতা ১। মোঃ আরিফ ব্যাপারী (২০) তার অন্যতম প্রধান সহযোগী ও চক্রের সক্রিয় সদস্য মোঃ জাহিদ (২৩) এবং অনিক (১৯)। এসময় তাদের হেফাজত থেকে ২০ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা মূল্যমানের জালনোট যার মধ্যে
৫০০ টাকার জাল নোট ৯২ টি এবং ১০০০ টাকার জাল নোট ২০০০ টি ছাড়াও প্রিন্টকৃত ৫০০ টাকার বিপুল পরিমান নোট এবং জালটাকা তৈরীতে ব্যবহৃত ১ টি কালার প্রিন্টার, ১ টি ল্যাপটপ, ১ টি মাউস, ১ টি ল্যাপটপ চার্জার, ২ টি প্রিন্টারের ক্যাবল, ১ টি মাল্টিপ্লাগ, ১ টি স্টীলের স্কেল, ১ টি এন্টিকাটার, ০১ টি স্কিন প্রিন্টের ফ্রেম, ১ টি টাকা কাটার কাঁচ এবং ২ টি মোবাইলফোন উদ্ধার করা হয়।
অধিনায়ক আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, গ্রেফতারকৃত আরিফ, জাহিদ ও অনিক বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া ও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে জাল টাকা বিক্রয়ের জন্য নেটওয়ার্ক তৈরী করে। তারা এ সকল পেইজ প্রমোট ও বুস্টিং করে অনেক পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা সংগ্রহ করে । এ চক্রটি বছরব্যাপী জাল নোট প্রস্তুত ও বিক্রয় করে আসলেও আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতরকে টার্গেট করে বিপুল
পরিমাণ জাল নোট বাজারে সরবরাহ করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তারা প্রতি ১ লক্ষ টাকা মূল্যমানের জাল নোট ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করত। ঈদ উপলক্ষে জাল নোটের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে তারা প্রতি ১ লাখ টাকার জাল নোট ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছিল।
গ্রেফতারকৃত আসামি আরিফ ব্যাপারী জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, শরিয়তপুর জেলার অধিকাংশ লোকই ইতালি
প্রবাসী এবং দেশে অবস্থানরত বড় একটি অংশ রাজধানীর বাংলা বাজারের বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে কর্মরত। পরিচিতদের সূত্র ধরে সে বিভিন্ন সময় রাজধানীর বাংলা বাজারে এসে অবস্থান করে প্রিন্টিং সম্পর্কে সম্যক ধারনা লাভ করে। সে ধারণা থেকেই জাল টাকা তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন রং, কালি ও কাগজ পুরান ঢাকা থেকে ক্রয় করতো।
এসব তৈরিকৃত জালনোট গুলো বিক্রয়ের জন্য আরিফ, জাহিদ এবং অনিক মিলে ফেসবুকে জালটাকা বিক্রয়ের বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপের (যেমন; এ গ্রেড জালনোট, টাকা চাই, জালনোট, জালটাকা বিক্রি করি, জাল টাকার ডিলার, জাল টাকা বিক্রয় কেন্দ্র, রিয়েল সেলস্, টাকা বিজনেস ইত্যাদি) পোস্টে জালটাকা ক্রয়ে আগ্রহী কমেন্টকারীদের সাথে ভুয়া আইডি খুলে ইনবক্সে যোগাযোগ করে। পরবর্তীতে তারা হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, ইমো প্রভৃতি অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে জালটাকা ডেলিভারির কাজ করে থাকে।
র্যাব-৩ অধিনায়ক বলেন, এ চক্রটি বিগত সময়ে জালটাকার বড় ধরনের একাধিক চালান ডেলিভারি দিয়েছে। তারা রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জ, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর এলাকায় জালনোট সরবরাহ করত। গতকাল ৫ লক্ষ টাকার জালনোট ডেলিভারির জন্য প্রস্তুতিকালীন সময়ে টাকা, মেশিন ও সরঞ্জামাদিসহ র্যাবের কাছে হাতেনাতে ধরা পরে ।
র্যাব বলছে, গ্রেফতারকৃত আরিফ এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। সে পড়ালেখা বাদ দিয়ে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার বাংলাবাজারে একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করতো। দোকানের কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করতো
সে টাকা জমিয়ে জালনোট ছাপানোর জন্য ল্যাপটপ, প্রিন্টার এবং প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করে। পরবর্তীতে সে তার নিজ বাড়িতে কম্পিউটারের দোকানে কাজের আড়ালে জাল নোট ছাপানোর কাজ শুরু করে। তার জালনোট ছাপানোর
কাজে অন্যতম সহযোগী হিসেবে জাহিদ এবং অনিক সহযোগিতা করতো। তারা জালনোট বিক্রি করে যে টাকা পেতো তার অর্ধেক আরিফ নিতো এবং বাকী অর্ধেক জাহিদ ও অনিক ভাগ করে নিতো।
গ্রেফতারকৃত জাহিদ নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। ২০২১ সালে সৌদি ফেরত জাহিদ পদ্মা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল বলে জানায়। কিন্তু সে অল্প পরিশ্রমে অধিক অর্থের আশায় মাছ ধরার আড়ালে গ্রেফতারকৃত আরিফের সাথে জালনোট ছাপানোর কাজ শুরু করে। সে জালনোট বিক্রির জন্য বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপে পোষ্ট করে কাস্টমার সংগ্রহ করতো। সে সকল পোষ্টে যারা কমেন্ট করতো তাদের সাথে ইনবক্সে যোগাযোগ করে
জালনোট বিক্রয়ের জন্য চুক্তি সম্পন্ন করতো। চুক্তি সম্পন্নকারী ক্রেতার নিকট জালনোট সরবরাহের সাথে সে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।
গ্রেফতারকৃত অনিক পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। সে তার পেশার আড়ালে গ্রেফতারকৃত আরিফ এবং জাহিদের সাথে জালনোট ছাপানোর কাজে যোগদান করে। সে তৈরীকৃত জাল টাকা প্রিন্টিং এর পর সঠিক সাইজ অনুযায়ী কাটিং এর কাজ করতো। পাশাপাশি ফোনে এবং অনলাইনে অর্ডারকৃত জাল টাকা বিভিন্ন জনের কাছে পৌছে দিতে ডেলিভারি ম্যান হিসেবেও কাজ করতো।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।