গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় এবার কাঁঠালের উৎপাদন হয়েছে গত বছরের চেয়ে বেশি। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে মাথায় হাত প্রায় চাষির। বিক্রি করতে না পারায় কাঁঠাল পেকে পচে নষ্ট হচ্ছে গাছেই। কেউ বা তিন ভাগের একভাগ দামে বিক্রি করছে। এছাড়া বাজারে চাহিদা না থাকায় তা কিনেও পুঁজি হারানোর শঙ্কায় পড়েছে পাইকাররা।
অপরদিকে, কাঁঠাল বাগান মালিকদের দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণের কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে ফলন বেশি হলেও অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারাচ্ছে কাঁঠাল।উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, শ্রীপুর উপজেলায় এবার ৭৭ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়েছে। যার বাজার দর ধরা হয়েছে ৩৮ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এবার কাঁঠাল উৎপাদন হয়েছে গত বছরের চেয়ে ২ হাজার ১৯০ মেট্রিক টন বেশি।বাগান মালিকরা জানান, প্রতিবছর মৌসুম শুরু হওয়ার এক-দেড় মাস আগেই বাগান নিয়ে পাইকারদের কাড়াকাড়ি পড়ত।
কিন্তু এবার চিত্র ভিন্ন। উপজেলার বাইরে থেকে কোন পাইকারের দেখা মেলেনি। স্থানীয় পাইকারদের মধ্যেও আগ্রহ অনেক কম। আর আগ্রহ দেখালেও দাম বলে কম।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবার দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে বাগানে ফলন দেখে কাঁঠাল কিনে নিত। পরে পুরো মৌসুমজুড়ে তারা তা বিক্রি করত। এবার সেইসব পাইকাররা আসেননি। এতে স্থানীয় পাইকারদের কেউ কাঁঠাল কিনেছে অর্ধেকেরও কম দামে।
আবার স্থানীয় অনেক পাইকারই এবার পুঁজি হারানোর শঙ্কায় কাঁঠাল কেনেননি।বরমী ইউনিয়নের বরকুল গ্রামের মাহমুদুল হাসান তানজিম জানান, বারবার স্থানীয় কয়েকজন পাইকারকে খবর দিয়েও আনা যায়নি। ফলে তার বাগানের কাঁঠাল এখনো বিক্রি করতে পারেননি। তিনি আরও জানান, একই অবস্থা তার চাচাত ভাই এসএম জাহাঙ্গীর আলমের। বিক্রি করতে না পারায় তাদের কাঁঠাল গাছেই পেকে পচে নষ্ট হচ্ছে।সাতখামাইর গ্রামের ব্যবসায়ী ইয়াকুব আলী জানান, প্রতিবছর তিনি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা কাঁঠাল বিক্রি করেন।
এবার গাছে কাঁঠালের ফলন বেশি হলেও পাইকারের আগ্রহ না থাকায় বাধ্য হয়ে মাত্র দুই হাজার টাকায় কাঁঠাল বিক্রি করেছেন তিনি।বারতোপা গ্রামের চাষি মো. সেলিম জানান, তার বাগানে প্রায় ৫ থেকে ৬শ কাঁঠাল রয়েছে। পাইকাররা কাঁঠালগুলোর সর্বোচ্চ দাম ৫শ টাকা হাকান। এতে সে কাঁঠাল বিক্রি করতে রাজি হননি। এখন কাঁঠাল পচে-গলে যাওয়ায় তা আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বাকিগুলো গৃহপালিত পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করছেন।কাওরাইদ ইউনিয়নের হয়দেবপুর গ্রামের শাহাব উদ্দিন মন্ডল জানান, গতবছর যে বাগান তিনি দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করেছিলেন।
এ বছর তা মাত্র ৭৮ হাজার টাকা বিক্রি করতে বাধ্য হন। অথচ গত বছরের তুলনায় এবার তার বাগানে কাঁঠালের ফলন প্রায় দ্বিগুণ।বরমী ইউনিয়নের খলারটেক গ্রামের বাগান মালিক মফিজুর রহমান বাবুল জানান, পাইকারদের কাছে গেলে তারা জানায়, আড়তদাররা কাঁঠাল কিনছে না।জৈনাবাজার কাঁঠালের আড়তদার জহির উদ্দিন জানান, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির জন্য দেশের কোনো এলাকা থেকেই কাঁঠাল ব্যবসায়ীরা আসতে পারছে না। ফলে আড়তদাররাও কাঁঠাল কিনছে না। তিনি আরও জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকার বড় বড় কাঁঠাল ব্যবসায়ীরা তাদের যে চাহিদা জানায়, ওই হিসেবে কাঁঠাল আড়তে মজুত করেন তারা। কিন্তু এবার কাঁঠাল ব্যবসায়ীদের সাড়া পাননি।শ্রীপুরের সবচেয়ে বড় কাঁঠালের বাজার জৈনা।
সেখানে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে কাঁঠালের বাজার বসত। এখান থেকেই কাঁঠাল যেত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকি বিদেশেও। রাত-দিন কাঁঠাল বিক্রি হত এ বাজারে। গত ৫ জুন থেকে কাঁঠালের হাটটি চালু হলেও ক্রেতার দেখা মিলছে না।জৈনা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কাঁঠালের হাটটির জৌলুস নেই। হাটের ইজারাদার শাহীন আলম জানান, প্রতিবছর হাটটি জমজমাট হয়ে ওঠে উপজেলার বাইরে থেকে কাঁঠাল ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিতে। কিন্তু এবার কোন ব্যবসায়ীই আসেনি।
ফলে তিনি এরই মধ্যে কোনো কাঁঠাল বিক্রেতার কাছ থেকেই টোল নেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেন।বাজারে বিক্রির জন্য কাঁঠাল নিয়ে আসা শফিকুল সর্দার জানান, সকালে ১০০ কাঁঠাল নিয়ে এসেছেন তিনি। মাত্র ১৫টি কাঁঠাল বিক্রি করেছেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখে বাকি কাঁঠাল ফেরত নিয়ে যাবেন বলে জানালেন তিনি।বাজারে ক্রেতা না থাকার প্রসঙ্গে কথা বললে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা বন্যা জানান, তারা কৃষি বিপণন অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
সেখান থেকে তাদের জানানো হয়েছে, শ্রীপুরের কোন বাগান মালিক যদি ক্রেতা না পায়, সেক্ষেত্রে তারা (কৃষি বিপণন অধিদফতর) নিজেদের পরিবহন ব্যবস্থায় ঢাকায় নিয়ে তা বিক্রির উদ্যোগ নেবে।উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আরও জানান, তারা মাঠে আছেন। ক্রেতা পাচ্ছেন না, এমন বাগান মালিকদের তালিকা তৈরি করছেন। দু’একদিনের মধ্যে তা কৃষি বিপণন অধিদফতরে পাঠানো হবে। এ ব্যবস্থায় বাগান মালিকদের কোন পরিবহন খরচ পড়বে না।