বিল্লাল হোসেন,যশোর প্রতিনিধি
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে প্রকাশ্যে নানা অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সময় এসব অনিয়মের বিষয়ে জেনেও কর্তৃপক্ষ নিরব থাকেন। যে কারণে অনিয়ম বেড়েই চলেছে। সরকারি এই হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে রোগীদের অভিযোগের শেষ নেই। সরকারি এই হাসপাতালের চিকিৎসক, সেবিকা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন করছেন ইচ্ছামতো। বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, প্রয়োজনের সময় বিশেষজ্ঞ চিকৎসক না পাওয়া, নিয়মবর্হিভূতভাবে ইন্টার্ণ চিকিৎসক রোগীর অস্ত্রোপচার ও রেফার্ড করছেন, হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগানো, কমিশন বাণিজ্য, দাপট, চিকিৎসাসেবায় অবহেলা, জখমী সনদ বাণিজ্য, বখশিস বাণিজ্য, বহিরাগতদের দাপট, বিনামূল্যের ওষুধ সঠিকভাবে বিতরণ না করা, এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। এছাড়া চিকিৎসাসেবার আগে চোখ রাঙানীতো রয়েছেনই। আবার এক বিভাগের কর্মচারী দায়িত্ব পালন করছেন আরেক বিভাগে। চাকরি ভাড়া দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে কিছু কর্মচারীর বিরুদ্ধে
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে প্রতিদিন দ্বিগুনের বেশি রোগি ভর্তি থাকেন। বহিঃবিভাগে চিকিৎসা সেবা নেন গড়ে প্রতিদিন ৯ শ থেকে ১ হাজার রোগী। যশোর ছাড়া ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইলসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ উন্নত চিকিৎসাসেবা পাওয়ার আশায় এখানে আসেন। এখানে আসার পর হাসপাতাল নিয়ে তাদের অভিযোগের শেষ নেই। কথা প্রসঙ্গে যশোর শহরের খোলাডাঙ্গার ফারুক হোসেন জানান, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সালমা খাতুনকে (২৮) অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর থেকে রোগীকে সঠিকভাবে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়নি। যন্ত্রনার মাঝেই ওয়ার্ডে দায়িত্বরত আয়ার উপস্থিতিতে সন্তান প্রসব করে। যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকার মামুন জানান, তার স্ত্রীকে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি করা হয়। রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ার পরও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসেননি। পরে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে রোগীর সিজার করানো হয়।
চৌগাছা উপজেলার সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের আড়শিংড়ী গ্রামের বাসিন্দা আবু তাহের (৭৫) জমিজমা নিয়ে জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় গুরুতর আহত হন । তাকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার সনদপত্রটি গ্রিভিয়াস করার নামে রোগির স্বজনদের সাথে ২৫ হাজার টাকা দাবি করে সাড়ে ১২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এই ঘটনায় হাসপাতালে তোলপাড় হয়। তদন্ত কমিটিও গঠন করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বর্তমানে জখমি সনদ বাণিজ্য বেড়েছে। সাধারণ জখমি সনদ নিতেও ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ২ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। আর গ্রিভিয়াস জখমি সনদ মিলছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। তদবিরের ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ আরও বেশি। আসাদুল ইসলাম , কবিরুল ইসলাম , শফিয়ার রহমানসহ কয়েকজন রোগীর স্বজন জানান, রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে দুইদিন কোন বিনামূল্যের কোন ওষূধ দেয়া হয়নি। ইনজেকশন ওমিপ্রাজল, সেফট্রিএ্যাকসন পর্যন্ত তাকে কিনে আনতে হয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল প্রশাসনিক সূত্র জানিয়েছে, সরকারিভাবে এই হাসপাতালে ৮৪ প্রকারের ওষুধ সরবরাহ কর হয়। এর মধ্যে ইডিসিএল ৪৪ প্রকার ও স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্থানীয় অর্থে টেন্ডারের মাধ্যমে অবশিষ্ট ৪০ প্রকার ওষুধ কর্তৃপক্ষ কেনেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জানা যায়, এ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন সেফট্রিএ্যাকসন, সেফ্রাডিন হাইড্রোকরটিসন, ওমিপ্রাজল, মেট্রোনিডাজল, ক্যাসিন, ক্যাপসুল সেফ্রাডিন, ক্লিনডামাইসিন, এমোক্সাসিলিন, সেফিক্সিম, ক্লিনডামাইসিন, ওমিপ্রাজল ৪০এমজি ও নাভিতে দেয়া ইনজেকশন, ট্যাবলেট এ্যালবেনডাজল, কারভিস্টা, সেফুরএক্সিম, সিটিরিজিন, ইটোরাক, ইসোরাল, হিস্টাসিন, লপিরিল, লপিরিল প্লাস, লোসারটন, মন্টিলোকাস্ট, ন্যাপ্রোক্সিন, অফলোক্সাসিন, প্যান্টোনিক্স, স্যালবোটল, রাবিপ্রাজল, সিরাপ এ্যামব্রোক্স বি-কমপ্লেক্স, সেফুরএক্সিম, ডমপেরিডন, লবুপ্রোফেন, ড্রপ সিপ্রোসিন, কেমিক্যাল রি এজেন্ট, সার্জিক্যাল গজ, ব্যান্ডেজ, ক্যাথেটার, মাইক্রোপর, জিপসোনা, সফ্টরোল, ক্রেপ ব্যান্ডেজ রোল, সার্জিক্যাল গ্লোভস, সোফরাটোলা, বালিশ, বালিশের কভার, মশারি নেট, লংক্লথ, টেট্রন ক্লথ, এ্যাডোমিনালসিট।
কিন্তু রোগীর স্বজনদের ভাষ্যমতে বাস্তবতা ভিন্ন। গুরুত্বপূর্ণ দামী কোন ইনজেকশন, ওষুধ ,লিলেন সামগ্রী ও গজ-ব্যান্ডেজ রোগীদের দেয়া হয়না। যৎ সামান্য ওষুধ দেয়া হয়। প্রায় ওষুধ ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। রোগী ও স্বজরা চাইলেই ওয়ার্ডে দায়িত্বরত সেবিকারা বলেন শেষ হয়ে গেছে। কথা বাড়ালেই করা হয় দুর্ব্যবহার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়ার্ড রাউন্ডে এসে চিকিৎসকেরা রোগী ও স্বজনদের আতংকগ্রস্থ করে তোলে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো রোগ সম্পর্কে জটিল ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের দুর্বল করে ফেলা। পরে কৌশলে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যক্তিগত হসপিটাল ও ক্লিনিকে। অর্থোপেডিক বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসক এমনটা করছেন সবচেয়ে বেশি। মুকুল হোসেন নামে এক স্বজন জানান, তার স্বজনের হাত ভেঙ্গে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু কবে অস্ত্রোপচার করবেন সে বিষয়ে কিছু বলা হচ্ছে না। রাউন্ডে এসে চিকিৎসকরা বলে যাচ্ছেন যত দ্রুত সম্ভব রোগীর অস্ত্রোপচার করিয়ে নেবেন। মুকুল আরো জানান, সরাসরি চিকিৎসক রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে নিতে না বললেও ইশারা দিয়ে বোঝাচ্ছেন। এছাড়া হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী রোগীকে ভাগিয়ে নিতে সর্বদা ব্যস্ত থাকেন। তারা হাসপাতালের বর্হিবিভাগ ও অন্তবিভাগে ঘোরাঘুরিও করেন। সূত্র জানায়, সরকারি এই হাসপাতালে এক বিভাগের কর্মচারী প্রভাব খাটিয়ে আরেক বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন। কর্তৃপক্ষ জেনেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। বরং কর্তৃপক্ষের সহায়তায় কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও বাগিয়ে নিয়েছেন। হাসপাতালে অবস্থান করে দেখা গেছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হাসপাতালে সঠিকভাবে তায়িত্ব পালন করেন না। প্রয়োজনের সময় তাদের ডেকেও পাওয়া যায়না। বিশেষজ্ঞদের অবহেলায় রোগীর ভাগ্যে ফলোআপ চিকিৎসা জোটেনা ঠিকমতো। ইন্টার্ণরা ওয়ার্ড রাউন্ডে এসে ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন “রিপিট অল”। অর্থাৎ আগে যে চিকিৎসা ছিলো তাই চলবে। হাসপাতালের বহিঃবিভাগে দায়িত্বরত অধিকাংশ চিকিৎসক রোগীদের জিম্মি করে কমিশন বাণিজ্যে মেতে রয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, তারা রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখে সরাসরি পাঠিয়ে দিচ্ছেন পছন্দের ক্লিনিকে। অথচ ওই পরীক্ষা সরকারি এ হাসপাতালেই সম্ভব। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য রোগীকে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানোর কারণে হাসপাতালে রাজস্ব কমছে তেমনি সাধারণ মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। টিকিটে কোনো প্রকার ওষুধ না লিখে পরীক্ষা করতে রোগীকে পাঠিয়ে দেয়ার ঘটনায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্যের কারণে প্রথম দিনে হাসপাতালে এসে অনেক রোগীর ভাগ্যে চিকিৎসা জোটেনা। টাকা ছাড়া কোন কাজ করতে চাননা কেউ। হাসপাতালে রোগী ভর্তির সময় জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে নেয়া থেকে শুরু করে ছাড়পত্র হতে পাওয়ার আগ মুহুর্ত নানা অজুহাতে টাকা আদায় করা হয়। বিগত দিনে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার চিত্র নিজ চোখে দেখে নাখোস হয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক ম্যানেজমেন্ট) অধ্যাপক ডা.কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছিলেন এখানে রোগির চিকিৎসাসেবার কোন পরিবেশ নেই। পরতে পরতে রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতি। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন অনিয়ম ও দুর্নীতি দুরে ঠেলে রোগির সেবা নিশ্চিত করার। কিন্তু অনিয়ম দুর্নীতি মোটেও পরিবর্তন হয়নি। তিনি ছাড়াও স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক উর্ধবতন কর্মকর্তা এই হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে অসন্তোষ প্রকাশ করে গেছেন। সূত্র জানায়, বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, রোগীর অপারেশনে গাফিলতি, বেসরকারিতে সিজারিয়ান অপারেশন ও চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা, রোগীর অস্ত্রোপচারে ইন্টার্ন চিকিৎসক, সুইপার ও ওয়ার্ডবয়, সরকারি অর্থ আত্মসাতসহ বিভিন্ন ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন হলেও শেষ পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়না। অধিকাংশ তদন্ত প্রতিবেদন থাকে ফাইলবন্দি। যে কারণে সরকারি এই হাসপাতালে অনিয়ম বেড়েই চলেছে। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আরিফ আহমেদ জানান, অনিয়ম ছাড়া কিভাবে রোগীরা চিকিৎসাসেবা পেতে পারে তার সকল উদ্যোগ গ্রহন রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালনের রোস্ট্রার রয়েছে। অনিয়মের কোন অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হয়। হাসপাতালের সকল কর্মকান্ড নিয়মের মধ্যে পরিচালনা করার জন্য বর্তমান কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপরেও বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে শুনলাম। খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।