যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে এই পর্যন্ত ১৪ রোগী কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। নমুনা পরীক্ষায় তাদের মধ্যে ২ জনের করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। বাকি ১২ জনের দেহে করোনার জীবাণু পাওয়া যায়নি।
এই তথ্য নিশ্চিত করে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আরিফ আহমেদ জানান, আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগী মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আতংঙ্কের মধ্যেও চিকিৎসক সেবিকারা রোগীদের সেবা দিয়ে চলেছেন। তবে আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষাভ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন মৃত রোগীর স্বজন।হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৩ মার্চ যশোরে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে করোনা সন্দিগ্ধ রোগীদের চিকিৎসাসেবার জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ড নামে আলাদা ইউনিট তৈরি করা হয়।
শুক্রবার পর্যন্ত(২৬ জুন) আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৩০৯ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৪ জন। তারা হলেন যশোর শহরের নীলগঞ্জ এলাকার মিল্টন শিকদারের স্ত্রী সেলিনা খাতুন (৩০), ঝুমঝুমপুর এলাকার মৃত কিসমত আলীর ছেলে আরশাফ আলী (৫৭) ও নওদাগ্রামের কায়েশ বিশ্বাসের ছেলে সাধু বিশ্বাস (৩১), চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলা গ্রামের পশ্চিমপাড়ার মৃত আলেক সরদারের ছেলে আব্দুল জলিল (৫৬), একই গ্রামের সরদারপাড়ার মৃত কেরামত আলীর ছেলে আব্দুল ওহাব আলী সরদারের (৭০), বলাডাঙ্গা গ্রামের জামির আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলী (৩০), রুপদিয়ার চাউলিয়া গ্রামের মৃত নাসির গাজীর ছেলে আব্দুল খালেক গাজী (৩৪), শার্শা উপজেলার বেনিপুড়ি গ্রামের আরশাফ আলীর ছেলে জিয়াউর রহমান (৩৭), শিয়ালকোনা গ্রামের মিজানুর রহমানের স্ত্রী জাহানারা বেগম (৬০), ঝিকরগাছা উপজেলার বর্ণি গ্রামের শাহিনের স্ত্রী শাকিলা খাতুন (২৪), হায়াত আলীর স্ত্রী জোহরা বেগম (৫৫), গদখালী এলাকার ইব্রাহিম মল্লিকের ছেলে রুহুল কুদ্দুস (৭০) ও চৌগাছা উপজেলার জামিরা গ্রামের মৃত কানু মন্ডলের ছেলে রেজাউল ইসলাম (৬০) ও স্বরুপদাহ গ্রামের আনারুল হকের ছেলে ভারত ফেরত আলমগীর কবির (৪৫)। ইতিমধ্যে সবার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ল্যাব থেকে হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে।
ফলাফলে দেখা গেছে উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ১৪ রোগীর মধ্যে ২ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের জীবাণু পাওয়া গেছে। তারা হলেন চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলা গ্রামের সরদারপাড়ার মৃত কেরামত আলীর ছেলে আব্দুল ওহাব আলী সরদারের (৭০) ও রুপদিয়ার চাউলিয়া গ্রামের মৃত নাসির গাজীর ছেলে আব্দুল খালেক গাজী (৩৪)। এদের মধ্যে আব্দুল ওহাব ২২ জুন ও খালেক গাজী ২৪ জুন মারা যান বলে আইসোলেশন ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার খাতায় উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া বাকি ১২ জনের ফলাফল নেগেটিভ শনাক্ত হয়েছে।
এদিকে মারা যাওয়া কয়েকজনর রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেছেন উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া সব রোগী করোনায় আক্রান্ত না হলেও করোনা আতংঙ্কে ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা মিলছে না আইসোলেশন ওয়ার্ডে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। এমনি দুই জন হলেন চুড়ামনকাটির ছাতিয়ানতলা গ্রামের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আব্দুল আজিজ ও চৌগাছা উপজেলার স্বরুপদাহ গ্রামের আনারুল হকের ছেলে ভারত ফেরত আলমগীর কবির।
শুক্রবার (১৯ জুন) আইসোলেশন ওয়ার্ডে মারা যাওয়া আব্দুল আজিজের ছেলে শামিম কবির ওয়াসিম জানান, জ্বর ও শ্বাসকষ্টের কারণে আমার পিতাকে এদিন সকালে ভর্তি করা হয়েছিলো। ভর্তির পর করোনা সন্দেহে আমার পিতার কোন চিকিৎসাসেবা মেলেনি। এমনকি কোন চিকিৎসক সেবিকা রোগীর কাছে পর্যন্ত আসেননি। জরুরি বিভাগ থেকে লেখা ব্যবস্থাপত্র অনুয়ায়ী ওষুধ বাইরে থেকে কিনে এনে নিজেরা খাইয়েছি। সেবিকাকে ডাকা হলেও কর্ণপাত করেননি।
একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় আমার পিতার মৃত্যু হয়। ২৩ জুন নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে জানতে পেরেছেন তিনি (আব্দুল আজিজ) করোনায় আক্রান্ত হননি। একই ধরণের অভিযোগ করেন ভারত ফেরত আলমগীর হোসেনের স্ত্রী সানজিদা আক্তার। তিনি জানিয়েছেন, আমার স্বামী কিডনি রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে ১০ এপ্রিল দেশে ফেরেন। ভারত ফেরত হওয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা তাকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠান।
করোনা আতঙ্কের কারণে আমার স্বামীর কোন চিকিৎসাসেবা মেলেনি। এক প্রকার ১৬ এপ্রিল রাতে বিনা চিকিৎসায় আমার স্বামী মারা যান। নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে আমার স্বামী করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না। চিকিৎসক সেবিকা ও কর্মচারিদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা (পিপিই) নিশ্চিত করে আইসোলশন ওয়ার্ড ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন রোগীর স্বজনরা। ফলে কোন রোগীর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মুখে পড়তে হবে না।হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আরিফ আহমেদ জানিয়েছেন, আইসোলেশন ওয়ার্ড নিয়ে রোগীর স্বজনদের সব অভিযোগ ঠিক না। করোনা আতঙ্কে চিকিৎসক সেবিকা দায়িত্ব পালন করছেন।
রোস্ট্রার অনুয়ায়ী ডিউটি করছেন না কিনা সেই বিষয়েও নিয়মিত তদারকি করা হয়। রোগী মারা যাওয়ার পর স্বজনরা নানা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিনা চিকিৎসায় রোগী মারা যাওয়ার লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরএমও জানান, করোনায় আক্রান্ত হোক আর না হোক রোগীর উপসর্গ থাকলেই চিকিৎসক ভর্তি করে আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠান। তারপর পরীক্ষার ফলাফলে নিশ্চিত হওয়া যায কোন রোগী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এই পর্যন্ত আইসোলেশন ওয়ার্ডে মারা যাওয়া মোট ১৪ রোগীর নমুনা পরীক্ষায় ২ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।