আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ছেলের চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে সাথে নিয়ে প্রথমবারের মতো ভারতে গিয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের বগুড়ার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। দুর্ঘটনায় আহত স্ত্রীকে লাশের স্তূপের পাশ থেকে উদ্ধার করে সেই পরিস্থিতিতে কীভাবে তিনি বেঁচে ফিরলেন সেই গল্প শুনিয়েছেন। ভয়ানক সেই মুহূর্তে নাম না জানা অপরিচিত স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া সেবা ও সহায়তার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন তিনি।
ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাবিবুর রহমান বলেছেন, তিনি প্রথমবারের মতো ছেলের চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলেন। ১২৮৪১-করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনে করে ভেলোরে যাওয়ার পথে শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এই ট্রেন। স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে করমন্ডল ট্রেনের এস-৪ বগিতে ছিলেন তিনি।
ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় আচমকা উল্টে যায় করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনের এস-৪ বগি। ৫ বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন হাবিবুর। দুর্ঘটনার সময় প্রচণ্ড শব্দের পর উল্টে যায় বগি। মুহূর্তের মধ্যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অনেকের শরীর। হাবিবুর ছেলেকে এক হাতে শক্ত করে ধরে কোনো রকমে বগি থেকে বেরিয়ে আসেন।
বগি থেকে বাইরে আসার পর অপরিচিত এক ব্যক্তির কাছে ছেলেকে রেখে স্ত্রীর খোঁজে ট্রেনের ওই বগিতে যান। ফিরে না আসা পর্যন্ত ছেলেকে দেখে রাখার অনুরোধ করে যান তিনি। ৩৮ বছর বয়সী হাবিবুর ধরে নিয়েছিলেন তার স্ত্রী হয়তো মারা গেছেন।
বগির বাইরে এসে স্ত্রী চামেলীর নাম ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করেন তিনি। পরে সেখানে আকাশের দিকে মুখ করে উল্টে যাওয়া বগির পাশে লাশের স্তূপের কাছে স্ত্রীকে আহত অবস্থায় খুঁজে পান হাবিবুর। অপরিচিত এক ব্যক্তি আহত চামেলীকে ট্রেনের ভেতর থেকে উদ্ধার করে বগির পাশে রেখেছিলেন। যেখানে অনেকের লাশ সারি সারি স্তূপ করে রাখা ছিল।
বাংলাদেশের বগুড়া জেলার দরিয়াপুরের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। ওড়িশায় দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পর সেখানকার অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে যে সহায়তা পেয়েছেন, তা কল্পনাতীত বলে জানিয়েছেন।
পরিবারসহ দুর্ঘটনার কবলে পড়া হাবিবুর ভয়ানক সেই মুহূর্তের কথা টেলিফোনে শুনিয়েছেন দ্য ট্রেলিগ্রাফকে…
‘এটা ছিল আমার প্রথম ভারত ভ্রমণ। আমার ছেলে রাহি সাদিকের চিকিৎসার জন্য ভেলোরে যাচ্ছিলাম। সে আমার কোলেই বসে ছিল। আর আমার পাশের আসনে ছিলেন স্ত্রী চামেলী। হঠাৎ তীব্র ধাক্কা অনুভূত হলো। এর পরপরই ট্রেনের সব বাতি বন্ধ হয়ে গেল।’
ভেতরে সব তছনছ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, দুনিয়াটা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ট্রেনের তীব্র ঝাঁকুনি থেমে গেল। তখন চারপাশে মানুষের আর্ত-চিৎকার শুরু হলো। মানুষ সহায়তা চেয়ে চিৎকার করছে। বগির ভেতরে মানুষ একে অপরের ওপর আছড়ে পড়ছে। সম্পূর্ণ অন্ধকারে আমি ছেলের হাত ধরে রাখতে রীতিমতো লড়াই করছিলাম।
‘ছেলের হাত ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। পরে ছেলেকে নিয়ে বগির বাইরে চলে আসি। বাইরে আসার সাথে সাথেই আমি এক ব্যক্তিকে অনুরোধ করলাম, আমার ছেলেকে তার কাছে রাখার জন্য। ওই ব্যক্তিও ট্রেনের বাইরে এসেছেন মাত্রই। তিনি অপরিচিত ছিলেন। তবে আমার কথাতে একবারেই রাজি হয়ে যান।’
আমি ট্রেনের বগির ভেতরে ফিরে যাই। সেখানে লাশের স্তূপ, সর্বত্র রক্ত। আর চারদিক থেকে মানুষ চিৎকার করছে। আমি যে আসনে বসেছিলাম, সেখানে ফিরে গিয়ে আমার ব্যাগটি খুঁজে পেলাম। এই ব্যাগে আমাদের সব পাসপোর্ট ও অন্যান্য নথিপত্র ছিল।
কিন্তু চামেলিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আমি আশপাশে তাকে খুঁজতে শুরু করলাম। তার নাম ধরে চিৎকার করতে থাকলাম। কিন্তু কোনও সাড়া পাচ্ছিলাম না।
পরে বগির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসি। আবারও আমার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে থাকি। হঠাৎ আমি তার ক্ষীণ কণ্ঠ শুনতে পাই। অনেক লাশের মাঝ থেকে এক অপরিচিত ব্যক্তি চামেলীকে উদ্ধার করে উল্টে যাওয়া বগির পাশে শুইয়ে রেখেছিলেন।
তৃতীয় এক অপরিচিত ব্যক্তি তার গাড়িতে করে আমাদেরকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। তিনি আমাদেরকে অর্থ সহায়তাও করেছেন। রোববার সকালের দিকে বাসে করে পেট্রাপোল সীমান্তে আসি। আমরা বাংলাদেশে ফিরেছি।
আমি জানি না এই অপরিচিত লোকজনকে কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাবো।
সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ।
বা বু ম / অ জি