1. tanvirinternational2727@gmail.com : NewsDesk :
  2. hrbangladeshbulletin@gmail.com : News Room : News Room
  3. 25.sanowar@gmail.com : Sanowar Hossain : Sanowar Hossain
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৫:১৮ অপরাহ্ন

ঢাকাকে বাঁচানোর অঙ্গীকার হোক আমাদের সবার

  • সময় : সোমবার, ৬ জুলাই, ২০২০
  • ৩৮৭

উৎপল ভট্টাচার্য্য, যুগ্ন জজ,জেলা জজ আদালত,ঢাকা

স্বপ্নের শহর ঢাকা। প্রাচীন শহর হিসেবে ঢাকার সুখ্যাতি এবং দুর্নাম দুটিই ছিল। মূলত ঢাকা শহরের গোড়া পত্তন হয় মোগল আমলে। জাহাঙ্গীর সম্রাট হিসেবে বসার পরে বাংলা সুবার রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে নির্বাচন করে।

এ কারণে ঢাকার প্রাচীন নামকরণ জাহাঙ্গীরনগর হিসাবে লক্ষ্য করা যায়। আনুমানিক 1610 খ্রিস্টাব্দে সুবেদার ইসলাম খান ঢাকার সুবেদার হিসেবে নিয়োগ পান। ঢাকা শহরের সমৃদ্ধি তার হাত ধরেই শুরু হয়। কিন্তু রাজধানী হিসেবে ঢাকা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি সব মিলিয়ে 75 বছরের কাছাকাছি সময়ে রাজধানী হিসেবে ঢাকার নাম মুছে যায় আবার চলে যায় মুর্শিদাবাদে। মূল কারণ ছিল বুড়িগঙ্গা নদী এবং ঢাকায় সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে মশার তীব্র উৎপাত। প্রায়ই বর্ষাকালে বুড়িগঙ্গার ভয়াল রূপ দেখতে পেত ঢাকাবাসী বন্যায় ভাসিয়ে নিত সবকিছু।

আবার মশার তীব্র উৎপাতে দেখা দিত জীবন গ্রাসী ম্যালেরিয়া। সে কারণে মোগল আমলে ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে ঢাকার সুখ্যাতি ছিল সর্বব্যাপী। ঢাকার মসলিন শাড়ি শুধুমাত্র ভারত বর্ষ নয় ইউরোপ এবং আরব বিশ্ব থেকে ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করত। যা ছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে দামি কাপড়। রাজধানীর পদমর্যাদা হারানোর কারণে ঢাকার লোকসংখ্যা কমে যায় হারিয়ে যেতে বসে ঢাকার প্রাচীন সৌন্দর্যমন্ডিত দালান প্রাসাদ। এখনো লালবাগ কেল্লা, বড় কাটরা সহ কিছু মোগল আমলের নিদর্শন রয়েছে। কলকাতা থেকে অনেক প্রাচীন শহর হওয়া সত্ত্বেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত ঢাকা শহরের গৌরবজ্জল ইতিহাস অনেকাংশেই চাপা পড়ে যায়।

১৯০৫ ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ এবং আসাম কে নতুন প্রদেশ হিসাবে ঘোষণা করার মাধ্যমে আবার প্রাণ পায় ঢাকা শহর। রাজধানী হিসেবে ঢাকা হয়ে ওঠে আবার এক উজ্জ্বল ঝলমলে শহর। হাইকোর্ট সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ঢাকা শহরে। পাল্টাতে শুরু করে ঢাকার মানচিত্র আবার দলে দলে লোক আসতে শুরু করে ঢাকা শহরে। রমনা এবং বর্তমান পল্টন কেন্দ্রিক গড়ে ওঠে ঢাকা শহর কিন্তু জমিদার এবং কলকাতা কেন্দ্রিক তথাকথিত উচ্চ শ্রেণীর আন্দোলনের মুখে 1911 সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয় আবার রাজধানী হিসেবে ঢাকার নাম মুছে ফেলা হয়। কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বঙ্গভঙ্গ রদের পর থেকে পুরোপুরি রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। যার বহিঃপ্রকাশ আমরা বারবার দেখেছি।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলে পূর্ব বঙ্গের রাজধানী হিসেবে ঢাকা পুনরায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ঢাকায় পুনরায় হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক সচিবালয়সহ নানারকম অফিস আদালত প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ঢাকা আবার তার স্বরূপে ফিরতে আরম্ভ করে। কিন্তু বারবারই শাসকগোষ্ঠী অবহেলা এবং অনাদরে রেখেছে আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহর কে। তৎকালীন সময়ে করাচি বা লাহোরের নতুন শহরের উন্নয়নে যে টাকা ব্যয় করা হতো তার খুব কম অংশই ঢাকা শহরের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হতো। পাকিস্তান আমলে ইসলামাবাদ কে নতুন রাজধানী করা হয় এবং গড়ে তোলা হয় পাকিস্তানের সবচাইতে সুন্দর এবং পরিকল্পিত শহর। কিন্তু সুপ্রাচীন ঢাকা শহরের নগরায়ন হলেও তা পরিকল্পিত কিংবা সুদুরপ্রসারি চিন্তা ভাবনা নিয়ে কখনোই গড়ে উঠে নাই। যদিও আইয়ুব খান কিছুটা পরিকল্পনা নেন কিন্তু তাও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঠিক তত্ত্বাবধান না থাকায় পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। 1951 সালে town improvement act করা হয় যা বর্তমানে রাজউক আইন নামে পরিচিত কিন্তু প্রথম থেকে দুর্নীতি আর অদূরদর্শিতার কারণে রাজউক পরিপূর্ণভাবে একটি পরিকল্পিত নগর হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং ঢাকা রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

একটি দেশের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় যাবতীয় সরকারি অফিস-আদালত এর পাশাপাশি নানারকম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে আরম্ভ করে শুরু হয় এক পরিকল্পনাহীন এবং দিশাহীন নগরায়ন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না করায় সবকিছুই গড়ে ওঠে ঢাকা কেন্দ্রিক। দলে দলে আসতে শুরু করে মানুষ। এমনকি দেশের স্বাস্থ্য চিকিৎসা সেবা এবং যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকায় গড়ে উঠতে আরম্ভ করে যে কারণে মানুষের স্রোত ঢাকামুখী হতে আরম্ভ করে। 80 এবং 90 এর দশকে গার্মেন্টস শিল্পের নবদ্বার উন্মোচিত হলো হাজার হাজার মানুষ ঢাকা শহরের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল।

এরপরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক-বীমাসহ সবকিছুই ঢাকাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মানুষের কর্মসংস্থান যেন ঢাকা কেন্দ্রিক হতে শুরু করে। কিন্তু ঢাকার আয়তন লোকসংখ্যা হিসাবে বেড়ে ওঠেনা। জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকা জনসংখ্যা আস্তে আস্তে গ্রাস করতে আরম্ভ করে মোগল আমলের সেই স্বপ্নের ঢাকাকে। ঢাকা হয়ে ওঠে যানজট আর নোংরা ভাগাড়ে। তারপরও প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় ঢাকা শহরে লোক সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পেতে থাকে। সম্পদ বিহীন একটি শহর শুধু মানুষের শহরে পরিণত হয়। কতগুলো অপরিকল্পিত বৃক্ষরাজি বিহীন কিছু ছাল চামড়া ছাড়া বিল্ডিং এর শহরে। যেখানে গড়ে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় আড়াই লক্ষ লোকের বসবাস বেশি কিছু আবাসিক এলাকায় তার সংখ্যা প্রায় 10 লক্ষের কাছাকাছি ।

পৃথিবীর আর কোন সম্পদহীন শহরে এত লোক সংখ্যার বসবাস নেই। ঢাকা শহরে না আছে পর্যাপ্ত অক্সিজেন দেয়ার মত গাছপালা কিংবা বিশুদ্ধ খাবার পানি তারপরও থামানো যায়নি মানুষের মহা মিছিল। যেভাবে হোক মানুষ মাথা গুঁজে ছিল। কিন্তু আজ পত্রিকাগুলোতে দেখি করোনার কারণে অনেক মানুষই ঢাকা ছাড়ছে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে ঢাকা শহর। কিন্তু শুধুই কি এ কারণে? আমার উত্তর হচ্ছে অবশ্যই না। হয়তো মহামারীর কারণে কিছুদিন আগেই ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। ছোট্ট একটি শহর কিন্তু দেশের একটি বৃহৎ অংশ জনসংখ্যার বসবাস যে শহরে না আছে কোন প্রাকৃতিক সম্পদ কিংবা শক্তিশালী কর্মসংস্থানের সুযোগ। অনেকটা দিন আনে দিন খায় এ ধরনের কর্মসংস্থানে অভ্যস্ত ঢাকা শহরের একটি বড় অংশ।

এ মহামারীর কারণে একজন রিকশাচালক কিংবা খুব হতদরিদ্রের থেকেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তথাকথিত মধ্যবর্তী পর্যায়ের মানুষগুলো। যারা নামে মধ্যবিত্ত কিন্তু আর্থিক সংগতি এবং কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে নিম্নবিত্তের থেকে নিচু স্তরে। ঢাকা শহরে সব ধরনের কর্মসংস্থানের লোক রয়েছে এবং সব ধরনের পেশাজীবী রয়েছে। যেমন রয়েছে সরকারি চাকুরিজীবি তেমনি রয়েছে ক্ষুদ্র দোকানের একজন কর্মচারী। যেমনি রয়েছে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আইনজীবী আবার রয়েছে সাপ খেলা দেখিয়ে জীবন চালানো পেশাজীবী । তেমনি এ শহরে রয়েছে মিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়ী তেমনি রাস্তার পাশে 500 টাকার তরকারি বিক্রি করে জীবনযাপন করা একজন মানুষ। অর্থাৎ নানা পেশার নানা মানুষের বসবাস ঢাকা শহরে।

কিন্তু ঢাকা শহর আর কতদিন এত মানুষের ভার বহন করবে? মাত্র তিন মাসেই ঢাকা শহরের 80 থেকে 90 শতাংশ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়েছেন। এসব কিছুর জন্য দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং মানুষের দুর্নিবার লোভ। সবাই মনে করে যে ঢাকা শহরে আসলে ধনী হওয়া যাবে। উদাহরণস্বরূপ ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে হোটেল ব্যবসা শুরু হয়, শুরু হয় স্কুল ভিত্তিক ব্যবসা। বিভিন্ন কোচিং সেন্টার কিংবা অপরিকল্পিত গার্মেন্টস ব্যবসা। যা এই মুহূর্তে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। কোনভাবেই এটাকে তুলে আনা সম্ভব নয়। এ সমস্ত পেশার বেশিরভাগ লোকই চিন্তা করতে পারেনি যে হঠাৎ করে এরকম বিপর্যয় আসবে। যে কারণে এ পেশা সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগকেই ঢাকা শহর ছাড়তে হচ্ছে। তেমনি অতি লাভের আশায় নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে গড়ে তোলা হয় যেখানে সেখানে ফ্লাট এবং বিল্ডিং যার ভাড়া রাখা হয় উচ্চহারে। ঢাকা শহরে বসবাসকারী মানুষের গড় আয় হিসাব করলে বাসা ভাড়া নিউইয়র্ক কিংবা টোকিওর থেকে অনেক বেশি। কিন্তু আমরা যখন নিজেদের তথাকথিত মধ্যবিত্ত ভাবতে শুরু করি প্রতিদিন যখন অর্থের যোগান থাকে চিন্তা করি না ভবিষ্যৎ কি হবে? যে কারণে সঞ্চয় বিহীন জাতিতে আমরা পরিণত হয়েছি।

নিজের এক লক্ষ টাকা আয় দেখে বেশি মূল্যের বাসা ভাড়া নিয়েছি, ব্যবহার করেছি সবচাইতে দামি স্মার্ট ফোন এবং যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কখনো ভেবে দেখিনি যদি কোন বিপর্যয় সে প্রাকৃতিক হোক আর মানুষ সৃষ্টি হোক আসলে কতটুকু মোকাবেলা করার সুযোগ রয়েছে? যে কারণে তিন মাসের মহামারীতে অশ্রু বদনে ছাড়তে হচ্ছে প্রানের শহর। যদি দ্রুত অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে এর চেয়ে ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে আমাদের কারণ শুধু করোনা মহামারী নয় যদি কখনো যুদ্ধকালীন অবস্থা তৈরি হয় কিংবা ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে তাহলে কি অবস্থা হবে।

একমাত্র তিন মাসেই আমরা পাঁচতলা থেকে রাস্তায় নেমে গেছি। আমাদের চিন্তা করা উচিত কিভাবে ঢাকা শহর কে বাঁচানো যায়? ঢাকাতে বিল্ডিংয়ের শহরের চিন্তা বাদ দিয়ে সবুজ শহরের চিন্তা করা উচিত তা না হলে মোগলরা ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে পরিত্যাগ করেছিল হয়তো আমাদেরও সেভাবে ঢাকা শহরকে ফেলে অন্য কোথাও রাজধানী শহর বানাতে হবে ।আমরা চাই না আমাদের প্রাণের ঢাকা হারিয়ে যাক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের অন্যান্য খবর
©বাংলাদেশবুলেটিন২৪