শামসুর রহমান তালুকদার-
টাঙ্গাইলে বিদ্যুতের লোডশেডিং দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জনজীবন।
টাঙ্গাইল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো)-১ এর আওতাধীন সদর উপজেলার করটিয়া, মাদারজানি, ক্ষুদিরামপুর, বীরপুশিয়া, বিসিক শিল্প নগরী তারটিয়া ও পৌরশহরের একাংশে দিনদিন লোডশেডিং বেড়েছে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জনজীবন। দিনের বেলায় সকাল ৮ টার দিকে বিদ্যুত চলে যায় আসে বিকাল ৫টায়। বর্তমানে বিউবো-১ এর আওতায় বর্তমান চাহিদা ২৪ মেগাওয়াট কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ১২ মেগাওয়াট। বিদ্যুত বিতরণ বিভাগ-১ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু দিনে নয় রাতে কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে যায়। এমন অভিযোগ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের।
এদিকে তীব্র গরমে বিদ্যুৎ না থাকায় ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়েছেন গ্রাহকরা। এছাড়াও প্রচণ্ড গরমে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা। গরমে ঘেমে জ্বর-কাশিসহ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। এতে বিদ্যুতের গ্রাহকরা ক্রমশই ফুঁসে উঠছে আর তৈরি হচ্ছে জনরোষ।
সারাদিন যেমন তেমন ঠিক সন্ধ্যার পর শহরের অধিকাংশ বিদ্যুতের এই লোডশেডিংয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাঘাত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। সন্ধ্যার পর অফিস-আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলেও লোডশেডিং তীব্র থেকে তীব্রতর হয় বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।
সদর উপজেলার তারুটিয়া গ্রামের বাছিরণ নামের এক গৃহবধু জানায়, সকাল ৮ টার পর থেকে বিদ্যুৎ চলে যায় আসে বিকাল ৫ টায়। এছাড়াও রাতে ৭-৮ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। মানুষ কিভাবে ঘুম আসবে, একটু ঘুম আসলে গরমে ঘুম ভেঙে গেলে দেখা যায় বিদ্যুৎ নেই।
করটিয়া ইউনিয়নের মাদারজানি গ্রামের আলামিন মিয়া জানান, গত ৮-৯ দিন ধরে প্রচন্ড গরমের পাশাপশি ব্যপক লোডশেডিং হয়। সারাদিন বিদ্যুৎ থাকে না। সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ আসে। একটু ঘুমের ভাব আসলে গরমে যখন ঘুম ভেঙে গেলে দেখি বিদ্যুৎ নেই। এ অবস্থায় রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারি না। ফলে কাজকর্ম করতে নানা অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। তিনি বলেন, এমন লোডশেডিং আগে কখনো দেখিনাই।
বিশিক শিল্প নগরী তারোটিয়া এলাকার বাসিন্দা মো. আয়নাল হক জানান, আগস্ট মাসে লোডশেডিং হতো কিন্তু গত কয়েকদিন যাবত বেশি লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। দিনের বেলায় বিদ্যুৎ তো থাকেই না রাতের বেলায়ও ৭-৮ বার লোডশেডিং হয়। এ গরমে কিভাবে মানুষ বাঁচবো। তিনি আরো জানান,দিনের বেলায় বিদ্যুৎ না থাকলেও এদিক সেদিক গাছতলায় বসে দিন পার করা যায়। রাতে যখন বিদ্যুত থাকেনা তখন খুব খারাপ লাগে। গত কয়েকদিন যাবত আমার ছোট ছেলে মেয়েরা রাতে ঘুমাতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
সদর উপজেলার অনেকের সাথেই কথা হয় বাংলাদেশ বুলেটিনের। তাদের অনেকেই জানান, বিদ্যুৎ-এর লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি বিদ্যুতের তারে ত্রুটি দেখা দিলে সহজে আর ঠিক হয় না। অফিসে বারবার ফোন করলেও লোকজন আসে না, রাতে ত্রুটি দেখা দিলে তো লোক আরো আসে না। তাদের এমন সেবার কারণে অনেক গ্রাহক ক্ষোভ প্রকাশ করলেও কিছু বলতে পারে না।
টাঙ্গাইল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড(বিউবো)-১ এর প্রকৌশলী খন্দকার কামরুজ্জামান বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, বিক্রয় কেন্দ্র-১ আওতায় ৪৮ হাজার পাঁচশ গ্রাহক রয়েছে। এখানে চাহিদা রয়েছে ২৪ মেগাওয়াট অথচ বরাদ্দ আসে ১০-১২ মেগাওয়াট। এ ঘাটতি কীভাবে পূরণ করবো। তারপরেও যতটুকু সম্ভব গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি।
অফিসে লোকবল বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই অফিসে লোকের প্রয়োজন ১০৩ জন রয়েছে ৩৯ জন। এর মধ্যে মাত্র ১৪ জন মেকানিক্যাল রয়েছে। এত অল্প মেকানিক্যাল দিয়ে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া কীভাবে সম্ভব, তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি।
টাঙ্গাইল বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ ২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সাহগীর হোসেন বাংলাদেশ বুলেটিনকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য মতে দেশে দিনে গড়ে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এতে প্রতিদিন লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের মতো।
তিনি আরো বলেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের সামিটের মালিকানাধীন একটি টার্মিনাল থেকেও গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। যার ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কমেছে।
এছাড়াও বিল বকেয়া থাকায় আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়েছে ৫০০ মেগাওয়াট। বেসরকারি খাতে থাকা তেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও বকেয়ার অঙ্ক বেশ বড়। তারাও সর্বোচ্চ উৎপাদনে যেতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে লোডশেডিং হচ্ছে।
তিনি আরো যোগ করেন যে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনব্যবস্থা বন্ধের দুঃসংবাদ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তিনটি ইউনিটের উৎপাদনই বন্ধ রয়েছে। সে হিসেবে ঘাটতি পড়ছে ২ হাজার মেগাওয়াটের মতো। তাই লোডশেডিং পরিস্থিতি আরও অবনািত হবার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তিনি এই বলে শেষ করে যে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। তবে চাহিদা মত যোগান কখনই ছিলো না। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা ছিলো। সামিটের ভাসমান টার্মিনাল বন্ধ থাকায় সরবরাহ নেমেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। আর বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ঘনফুটে। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার মেগাওয়াট। যেখানে আড়াই মাস আগেও এখান থেকে উৎপান ছিলো দৈনিক ৬ হাজার মেগাওয়াট। মূলত: এ কারণেই লোডশেডিং বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তরনের চেষ্টা চলছে। দ্রুত সমাধান হবে বলে আশা করি।