1. tanvirinternational2727@gmail.com : NewsDesk :
  2. hrbangladeshbulletin@gmail.com : News Room : News Room
  3. 25.sanowar@gmail.com : Sanowar Hossain : Sanowar Hossain
রবিবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৩ অপরাহ্ন

বিএনপি’র  বিদেশী বন্ধু তত্ত্ব কতটা সত্য ?

  • সময় : মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৩
  • ৩৩

ফেরদৌস আরেফীন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামের দলটি নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিদেশী শক্তিগুলোর ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কথাবার্তায় মনে হয় যেন, শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন-সংগ্রামে আমেরিকা-ইউরোপ তাদের কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে রেখেছে ! বিশেষ করে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হ্যাসের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সখ্যতা এবং তার কিছুকিছু বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করে পিটার হ্যাসকে অবতার বা ভগবান নামে ডাকতেও দেখা গেছে বিএনপির শীর্ষ নেতাদেরকে।


তবে, বিএনপির শীর্ষ নেতারা যখন তাদের পাশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রয়েছে বলে দাবি করেন, তখন তারা এমনভাবে কথা বলেন তাতে মনে হয় যেন শুধু আমেরিকাই নয়, ভারত বাদে পুরো আন্তর্জাতিক বিশ্বই যেন বিএনপি’র পাশে রয়েছে, তথা শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।


কিন্তু কুটনৈতিক রাজনীতি বিষয়ে বিএনপি’র অতীত ইতিহাস আসলে কি বলে? অতীতে দুই দফা ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপি’র কুটনৈতিক কর্মাকাণ্ডগুলোকে কি কোনোভাবে সফলতার কাতারে ফেলা যায়? সরকার হিসেবে বিএনপি’র কুটনৈতিক তৎপরতা কোন মানের ছিলো?


শুরুতেই চীনের প্রসঙ্গে আসা যাক। চীন ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি’র মিত্র –এটা ব্যাখ্যা করে বলার কিছু নেই। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে রাষ্ট্র হিসেবে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে এর চরম অবনতি ঘটে। বিএনপি’র সঙ্গে চীনের অতীত সব হিসাবনিকাশ পাল্টে যায় বিএনপি সরকারের নেয়া আজব কিছু সিদ্ধান্তের কারণে। ২০০৪ সালে ঢাকায় তাইওয়ানের তাইপেই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অফিস খোলাকে কেন্দ্র করে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের বিপর্যয় ঘটে বিএনপি’র। তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশে তাইওয়ানের কনসুল অফিস খোলার জন্য দায়ী ছিলেন এবং সেসময় এজন্য তাকে বাণিজ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগও করতে হয়েছিলো। তাইওয়ানকে বাংলাদেশে অফিস খুলতে দেওয়ার বিষয়টি বিএনপির তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানও জানতেন না। তারেক রহমানের ইচ্ছায় আমীর খসরু গং এই কাজটি করেছিলেন, যাতে চীন মারাত্মক ক্ষুব্ধ হয়েছিলো। বিস্ময়কর হলেও সত্য, ২০১৮ সালে  সেই আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকেই ‘টিম লিডার’ করে বিএনপি’র ফরেইন অ্যাফেয়ার্স কমিটি পুনর্গঠন করা হয় ! তারপর যা হয়েছে তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?


এবার আসা যাক ভারত প্রসঙ্গে। ভারতের অন্যতম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি’র সঙ্গেও বিএনপি’র সম্পর্ক চীনের মতোই ঐতিহাসিক। সৃষ্টির পর থেকেই ধর্মীয় মৌলবাদ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের দীর্ঘ সম্পর্ককে পুঁজি করে বিএনপি ও বিজেপি’র মধ্যে এক অদৃশ্য মেলবন্ধন তৈরি হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, ভারতের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি জয়লাভ করলে বিএনপি’র নয়াপল্টন কার্যালয়ে মিষ্টি বিতরণের ঘটনা ছিলো নিত্যনৈমিত্যিক।


কিন্তু ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা বিএনপি’র সঙ্গে বিজেপি তথা ভারতের অতীত সকল হিসাবনিকাশ ওলটপালট হয়ে যায়। ভারতের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর জন্য পাচার হতে যাওয়া সেই বিপুল পরিমান ভারি অস্ত্রসস্ত্র পাচারের ঘটনার সময় বিএনপি যে ক্ষমতায় ছিলো শুধু তাই নয়, বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব সরাসরি সেই অস্ত্র পাচার চেষ্টায় জড়িত ছিলো –যা গোটা ভারত এবং ভারতের যে কোনো মূলধারার রাজনৈতিক দলের জন্য ছিলো প্রচন্ড শঙ্কার ও ভয়ের।
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানসহ বিএনপি সরকারের উধ্বর্তনরা। এই অস্ত্র ভারতের উলফা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দেওয়ার জন্য খালাস করা হচ্ছিল। চট্টগ্রাম থেকে স্থলপথে ভারতে উলফার কাছে এ অস্ত্র প্রেরণের পরিকল্পনা ছিলো। এই অস্ত্র ভারত সীমানায় প্রবেশ করলে সেদেশে কি ভয়াবহ পরিস্থিতি হতো তা চিন্তারও অতীত। এই ঘটনায় মুহূর্তেই বিজেপি বিএনপি’র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, বিএনপি তার একমাত্র ভারতীয় বন্ধুটিকেও হারায়। তবে এর আগেও ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে বিএনপি’র আচরণ ছিলো বিমাতাসূলভ এবং মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ। ১৯৮০ সালের ২১ জানুয়ারি বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একটি সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে যান। সেই সফরে ফারাক্কা ইসু এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বিষয়ে জিয়া পুরোপুরি নীরব ভূমিকা পালন করেন। আর এসব প্রসঙ্গে জনপ্রিয় দৈনিক দ্যা হিন্দুর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ফারাক্কা বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কিছু বলার নেই।” অন্যদিকে বাণিজ্য ঘাটতি প্রসঙ্গে জিয়া বলেন, “ভারত বড় দেশ, তাই বাণিজ্য ঘাটতি স্বাভাবিক ঘটনা।”


আবার, ১৯৯২ সালে ভারত সফরে যান বিএনপির তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ। ওই সফরের যৌথ ঘোষণায় ভারতের পণ্য সরবরাহ সুবিধা দিতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হলে কর্নেল অলি তাতে কোনোই কর্ণপাত করেননি, যা পরবর্তীতে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যে ব্যাপক নেতীবাচক প্রভাব ফেলেছিলো। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তিন দিনের সফরে ভারত যান। সেখানে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ফারাক্কা, তিস্তা ও অমীমাংসিত সীমানা প্রশ্নে কোনো আলোচনা হয়নি। দেশে ফিরে ফারাক্কা প্রশ্নে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে খালেদা জিয়া বলেছিন, “প্রসঙ্গটি আমি ভুলে গিয়েছিলাম”।
এতো গেলো শুধু মিথ্যাচারের গল্প। কিন্তু ভারত বিষয়ক কিছু ক্ষেত্রে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার আচরণ ছিলো রীতিমতো বিকৃত। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা যখন ২০০৫ সালে মারা গেলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একটি শোকবার্তা পাঠানোর প্রয়োজনও অনুভব করেননি, যা ওই সময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ব্যাপক নেতীবাচক প্রভাব ফেলেছিলো। অথচ সেই খালেদা জিয়াই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ১৯৯৩ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ নওয়াজ জানজুয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে শোক বিবৃতি পাঠান। জেনারেল জানজুয়া ১৯৭১ সালে বা্ংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিলো। ওই বিবৃতি প্রটোকলে না পড়ায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফও ব্যাপক বিব্রত হয়েছিলেন। কতটা বিকৃত হলে খালেদা জিয়া ও তার দল এ ধরনের অদ্ভুত্ আচরণ করতে পারেন ! আবার, ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময় তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতে-ইসলামীর ডাকা হরতালকে অজুহাত দেখিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন। এই ঘটনায় ভারতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক বলতে গেলে তলানীতে গিয়ে ঠেকে।


আবার, ২০১৫ সালে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, খালেদা জিয়াকে ফোন করে শরীর-স্বাস্থ্যের খোজ নিয়েছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ।  [প্রথম আলো, ১১ জানুয়ারি ২০১৫]। কিন্তু বিজেপি সভাপতির একান্ত সচিব এস রানা দিল্লিতে এ প্রসংগে সাংবাদিকদের জানান, “বাংলাদেশে কাউকে অমিত শাহ ফোন করেননি। বাংলাদেশ থেকে কোনো ফোনও আসেনি”। ১৩ জানুয়ারি ২০১৫, দৈনিক প্রথম আলো লিখেছিলো, “অমিত শাহ-খালেদা জিয়া ফোনালাপের বিশুদ্ধ গুজবটি বিএনপিই রটিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা এদেশের সংবাদমাধ্যমকে বিভ্রান্ত করেছে। বিএনপির এমন বিভ্রান্তি ছড়ানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না; গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের এমন প্রবণতা অতি নিন্দনীয়।” এই ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশের গণমাধ্যমেই ব্যাপক হাস্যরসের উপদানে পরিণত হয়, কিন্তু বেহায়া দল বিএনপি’র নেতাদের লজ্জা বলতে কিছু না থাকায় তারা সেটিও হজম করে ফেলেন।


এবার আসা যাক বিএনপি যে আমেরিকাকে নিজেদের ‘অবতার’ মনে করে, তাদের প্রসঙ্গে। ২০১৫ সালে খালেদা জিয়াকে নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের ছয় সদস্যের একটি ভুয়া বিবৃতির কথা জানায় বিএনপি। ওই বিবৃতি লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এক সহকারী ও বিএনপি যুক্তরাষ্ট্র কমিটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ জসীমউদ্দিন ভূঁইয়া সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন। পরে মিথ্যা বিবৃতির সেই বিষয়টি নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিলো বলেও প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছিলেন সেই জসীমউদ্দিন ভূঁইয়া। ২০১৫ সালে বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের ছয় সদস্য খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা এবং তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছেন।” এর পরপরই ওই কংগ্রেস সদস্যরা সাংবাদিকদের জানান, তারা এমন কোনো বিবৃতি দেননি।


এসব ঘটনার বাইরেও, বেশকয়েকটি রাষ্ট্র থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রকল্প, অনুদান ইত্যাদি নিয়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানের দুর্নীতি ও লুটপাটের ফলে অনেক দেশই বিএনপি থেকে যে পুরেপুরি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলো –তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর ইজরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে বিএনপি’র নীরবতা এবং ইজরায়লের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সম্পৃক্ততার পর ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর কাউকে আর বিএনপি ভবিষ্যতে পাশে পাবে বলেও মনে হচ্ছে না। এইসব ঘটনা বিবেচনা করলে বিদেশী বন্ধুদের নিয়ে বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তাগুলো কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়? যে দল বিদেশী নীতিনির্ধারকদের নিয়ে একের পর এক মিথ্যাচার করে, সাময়িক লোভের কারণে দীর্ঘদিনের মিত্রদের সঙ্গে গোপনে একের পর এক হঠকারীতা করে –সেই বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসার জন্য বিদেশীদের পাশে পাওয়ার দাবি করে –তা কি জাতির কাছে হাস্যকর ঠেনে না? এটুকু বোঝার ক্ষমতাও বোধহয় বিএনপি নেতারা হারিয়ে ফেলেছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের অন্যান্য খবর
©বাংলাদেশবুলেটিন২৪