1. tanvirinternational2727@gmail.com : NewsDesk :
  2. hrbangladeshbulletin@gmail.com : News Room : News Room
  3. 25.sanowar@gmail.com : Sanowar Hossain : Sanowar Hossain
বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
 ‘কেমন পুলিশ চাই’জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হাইকমিশনে হামলা জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট বরখেলাপ- বিএনপি মহাসচিব পার্শ্ববর্তী দেশের গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা খবর প্রচার করছে-স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মার্চে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ-ইসি পার্বত্য অঞ্চলকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়-প্রধান উপদেষ্টা নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রথম বৈঠক আজ প্রধান উপদেষ্টার  নিকট  ‘অর্থনীতির শ্বেতপত্র’ হস্তান্তর খুনের পরিকল্পনা আগেই জানতো পুলিশ, ছুরিকাঘাতে ব্যবসায়ীর মৃত্যু দেশের ক্রান্তিকালে সেনাবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে-সেনাপ্রধান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায়  তারেক রহমানসহ সকল আসামি খালাস

‘বলাকা’য় বোম্বেটে

  • সময় : শুক্রবার, ২৩ জুলাই, ২০২১
  • ৩২৫


কমলকুমার ঘোষ।সাংবাদিক, গবেষক ও লেখক৷

সকাল তখন আটটা । লতিফ এসে দেখল, ‘বলাকা’-র মেন গেটটা হাটকরে খোলা । যা সচরাচর হয় না।কাজের মেয়ে লক্ষ্মী বা ম্যাডাম নিজেইরাতে দরজায় তালা লাগিয়ে দেন। একটু অবাকই হল লতিফ ।

কাল সারারাত যেন আকাশে বাণ ডেকেছিল । সেই বৃষ্টির হাল্কারেশ এখনও আছে। অন্যদিন লতিফ এত তাড়াতাড়ি আসে না। কারণ, ম্যাডাম তো অফিসে বেরোবেন এগারোটা নাগাদ । তাই দশটায় আসে ।কিন্তু গতকাল ছিল রবিবার । ছুটির দিন। আজ তাই আগে এসেছে, গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বের করে ধুয়ে-মুছে রেডি করে রাখবে বলে ।

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে লতিফেরচোখে পড়ল, গেটের বাইরে পাঁচিলের পাশে মোটরবাইকের চাকার দাগ। বুঝতে পারল, কাদার মধ্যে বাইকের চাকাটা বসে গিয়েছিল । ফুলপিক্আপ্‌ দিয়ে গাড়িটা তুলতে হয়েছে। তাই, একটা গর্ত হয়ে গেছে।বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে বাড়ির ভেতরে পা চালাল লতিফ হোসেন ।

‘বলাকা’-কে ঠিক বাড়ি বললে মানাবে না । বাংলো প্যাটার্ন । খানিকটা শান্তিনিকেতন স্টাইলে । তবে, ভেতরে ঢুকলে বোঝা যাবে, আসলে এটা ডুপ্লেক্স । পাশে গাড়ির গ্যারেজ । বেহালা এয়ারপোর্টেরকাছে এখন প্রচুর বাড়ি। সারি সারি মাল্টিস্টোরেড ৷ তার মাঝে এই বাড়িটা যেন ‘জরা হট্‌কে’ । অন্য গোত্রের । আসলে বছর ত্রিশ আগেঅধ্যাপক চিন্তাময় দাশগুপ্ত এই ছ’কাঠা জমি কেনেন প্রায় জলের দরে ।এক বন্ধুর পরামর্শে । তখন বেহালার এই অঞ্চলটা আজকের মতোনিরাপদ নয়। বরং ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক । সমাজবিরোধীদের মুক্তঅঙ্গন । তবু, খানিকটা কিন্তু কিন্তু করেও শেষ পর্যন্ত জমিটা কিনেইফেলেন চিন্তাময়বাবু । ভাবেন, ভবিষ্যতে উত্তর কলকাতার পাঠ চুকিয়েএখানে নিরিবিলিতেই কাটাবেন অবসর জীবন । তারপর বছর পনেরোআগে জমিটা ঘিরে তার মাঝখানে তৈরি করেন এই বাংলো । এখনযেখানে তাঁর মেয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক অঞ্জনা দাশগুপ্তেরবাস।

গেট থেকে একটু এগোলেই চারটে সিঁড়ি। তারপরেই বাংলোর মূলদরজা । লতিফ দেখল দরজাটা বন্ধ । বেল বাজাল ৷ কেউ উত্তর দিল না। আবার বারকয়েক বেল দিয়ে কোনও সাড়া না পেয়ে, লক্ষ্মীদি লক্ষ্মীদিবলে ডাকতে শুরু করল । কিন্তু না, কারও কণ্ঠস্বরই শোনা গেল না।লতিফ তখন নেমে এসে বাংলোর চারপাশটা ঘুরে দেখল । একতলারকোনও জানলাই খোলা নেই। শুধু দোতলায় ম্যাডামের ঘরের একটাজানলা খোলা । এবং সেখানে আলো জ্বলছে । সেদিকে তাকিয়ে লতিফজোরেই বলে উঠল,   – ‘ম্যাডাম, শুনছেন? আমি লতিফ । দরজাটাখুলুন ।’ আবার বলল- ‘ম্যাডাম, চাবিটা দিন । গাড়ি বের করব’ । না, এবারও কোনও উত্তর ভেসে এল না । এতে তার মনে একটা খটকালাগল । কারণ, সে জানে, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যোগ ব্যায়ামকরাটা ম্যাডামের নিত্য-অভ্যেস । পাঁচ বছর ধরে

সে দেখে আসছে । লতিফ এবার অঞ্জনার মোবাইলে ফোন করল । কিন্তুফোনটা সুইচড্‌ অফ ।

আবার লতিফ ফিরে গেল মূল দরজায় । ভাবল, ‘একটু জোরেঠেলে দেখি তো, খোলে কিনা! কিন্ত জোরে নয়, একটু চাপ দিতেই একপাল্লার দরজাটা খুলে গেল । অর্থাৎ দরজাটা আসলে খোলাই ছিল ।লতিফ বেশ অবাক হল ।

ভেতরে ঢুকে লতিফ কাউকে দেখতে পেল না। এমনকি কিচেনেওনা। ঘরের ভেতরের ঘোরানো সিঁড়িটা দিয়ে সোজা উঠে গেল দোতলায় ।এবার তার চক্ষুম্থির । সে দেখল, অঞ্জনার বেডরুম লন্ডভন্ড । ঘরেরজিনিসপত্র, জামাকাপড় চারিদিকে ছড়ানো । আলমারি ভাঙা ।লতিফের বুকের মধ্যে ত্রিতাল বাজতে শুরু করল । তাহলে কি এ’বাড়িতেকাল রাতে ডাকাতি হয়েছে? নাকি, কারোর ওপর রেগে গিয়ে ম্যাডামএইসব কাণ্ড বাধিয়েছেন? কারণ, লতিফ জানে, ম্যাডাম অত্যন্ত রগচটা ।সামান্য ভুলচুক হলে তাকেও ছেড়ে কথা বলেন না। কিন্তু ম্যাডাম গেলেনকোথায়?

এইসব ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে গেল অঞ্জনার স্টাডি রুমের দিকে। দরজাটা ভেজানো ছিল। ঠেলে খুলতেই লতিফ যেন চারশো চল্লিশওয়াটের শক্‌ খেল । সামনে তার ম্যাডাম । অঞ্জনা দাশগুপ্ত । বেপরোয়ামহিলা সাংবাদিক হিসেবে যাঁকে সবাই বেশ সমীহ করে চলে । পুরুষেরঅত্যাচার থেকে বাঁচানো, অধিকার রক্ষা এবং ন্যায়বিচারের জন্য যেকাগজ সবসময় মহিলাদের পাশে দাঁড়ায়, সেই ‘নারী এবং’ পত্রিকারসম্পাদক, তাঁর লেখার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছেন । স্থবিরেরমতো । হাত, পা দড়ি দিয়ে বাঁধা । মুখে কাপড় গোঁজা । গায়ে ও মাথায়ইলেকট্রিক তার জড়ানো । সেই তারের শীর্ষবিন্দুটা টু-পিন প্লাগের মাধ্যমেদেওয়ালের বোর্ডে গোঁজা । ত্রিতাল তখন দ্রুত হয়ে বাজছে । তার মধ্যেইলতিফ লক্ষ্যে করল, ম্যাডামের মুখ, চোখ কেমন যেন একটু নীলচে হয়েগেছে। মুখটা যন্ত্রণাবিদ্ধ । মাথাটা একটু নুইয়ে আছে।

একটা ঠাণ্ডা ভয় কিন্ত ততক্ষণে লতিফের শিরা-উপশিরায়হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত হু হু করে ঘাম নামছেজলপ্রপাতের মতো । মুহূর্তের মধ্যে সে সম্বিত ফিরে পেল । বুঝতে পারল, এক্ষুণি তার এখান থেকে পালানো দরকার । কারণ, পুলিশ ছুঁলে কতঘা, তা আজ পর্যন্ত কেউ হিসেব কষে বের করতে পারেনি । যেমন ভাবাতেমন কাজ । দ্রুত সে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল নিচে । নামারসময় শেষ ধাপে পা হড়কে গেলেও, নিজেকে কোনওমতে সামলে, বাংলোর দরজাটা খুব আস্তে বন্ধ করে মাটিতে নামতেই দেখে, ‘বলাকা’-র গেট দিয়ে লক্ষ্মী ঢুকছে।

তাকে দেখে লতিফ খুব ঘাবড়ে গেল । এবার কী হবে? লক্ষ্মীকে সেকী বলবে? সে ফেঁসে যাবে না তো? লক্ষ্মী বলল – ‘কী লতিফ ভাই, কেমনআচ? দিদির চান হয়ে গেছে?’

নিজেকে খানিকটা সামলে, রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতেমুছতে লতিফ বলল – ‘কী জানি, ঠিক বুঝতে পারছিনা । কতবার বেলবাজালাম, ডাকলাম ম্যাডাম তো সাড়া দিলেন না ।দরজাও খুললেন না’ ।

তারপর কথা ঘোরানোর জন্য বলল – ‘তা, তুমি কোথায় ছিলেলক্ষ্মীদি?’

লক্ষ্মী বলল—‘আমার বাপের হঠাৎ মাথার ব্যামো দেখা দেচে।তাই. দিদির কাছ থেকে কাল ছুটি নে তারে দেখতে গেচিলুম । বিষ্টি-বাদলার জন্যি সকালে বাস তেমন চলতিচে না। নাইলে, আর একটুআগে আসতুম ৷’

লতিফ বলল-_’সে তো খড়িবেড়িয়া?’

লক্ষ্মী উত্তর দিল__ ‘খড়িবেড়ে থেকে আরও চার কিলোমিটারভেতরে গো’ ।

লতিফ দেখল, এই কথার ফাঁকেই কেটে পড়া ভালো । তাই বলল-‘তাহলে আমি চলি লক্ষ্মীদি। তুমি থাকো । দেখ, ম্যাডাম কখন দরজাখোলেন’ ।

একথা শুনে লক্ষ্মী একটু ঝাঁঝিয়ে উঠল – ‘সে কী কতা? আমাকে একা ফেলে তুমি চলে যাবে কী গো ? তার চেয়ে বরং মেসোমশাইকে একটাফোন করো । তারে সব বল। দিদির তো কোনও বিপদআপদও হতিপারে’

লতিফ ভাবল, এ তো আচ্ছা গেরোয় পড়লাম! ম্যাডামের বাবাকেখবর দিলে, কানের সঙ্গে তো মাথাটাও চলে আসতে পারে ! মনে মনেবলল, হায় আল্লা, আমাকে বাঁচাও ৷ এমন এক ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতি যে, ফোন করলে বিপদ হতে পারে । আবার না করলেও এই আপদ লক্ষ্মীচেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে পারে । বেলাও বেড়েছে । সপ্তাহের প্রথমদিনবলে, রাস্তায় লোকজন ও গাড়ি চলাচলও নজরে পড়ছে।

অগত্যা লতিফ চিন্তাময়বাবুকে ফোন করল । সকাল থেকে যা যাঘটেছে, সবই বলল। শুধু অত্যন্ত নিপুণভাবে সে যে খুন হয়ে যাওয়াঅঞ্জনাকে প্রথম দেখেছে, সেই কথাটা চেপে গেল । ভাবল, আগ বাড়িয়েবেশি কথা না বলাই ভালো ।

চিন্তাময়বাবু বললেন – ‘সে কী? ঠিক আছে, আমি দেখছি। তোমরাওখানেই থাকো’ ।

লতিফ বুঝতে পারল, পালাবার আর পথ নেই।

চিন্তাময় দাশগুপ্ত এখন সমাজের একজন অন্যতম নামী মানুষ৷মেয়ের পরিচয়ে নয়। নিজের অর্জনে । অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ।পার্টটাইম লেকচারার । প্রাবন্ধিক । যুক্তিবাদী সমিতির সহ-সভাপতি ।এবং সি পি আই দলের প্রথম সারির নেতা । ফলে, ওপরমহলে তাঁরবিস্তার যথেষ্ট ।

চিন্তাময়বাবু প্রথমে মেয়েকে ফোন করলেন। না। অঞ্জনার দুটোফোনই বন্ধ । শুধু হট্‌ লাইনটা বেজে যাচ্ছে। নো রিপ্লাই । এবার তিনিসত্যিই একটু চিন্তায় পড়লেন । দরজা ভেতর থেকে বন্ধ । ফোনে পাওয়াযাচ্ছে না । তাহলে কি অঞ্জু মা কোনওভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল? এরচেয়ে বেশি কোনও অশনিসংকেত তার মনে ভেসে উঠল না।

সাধারণত এইসব ক্ষেত্রে প্রথমেই উচিত ডাক্তারকে ডাকা । কিন্তুএখানে সেটা সম্ভব নয় । কারণ, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ । অতএবপুলিশে খবর দেওয়া দরকার ।

কিন্তু চিন্তাময়বাবু ভাবলেন, তার আগে বাড়ির লোকেদের ঘটনাটাজানা জরুরি । বাড়ির লোক বলতে, ছেলে আর বৌমা । স্ত্রী সুনন্দাদাশগুপ্ত অঞ্জনার জন্মের সময়েই চোখ বোজেন। সে তো প্রায় সাঁইত্রিশবছর আগের কথা । তারপর থেকে দুই ছেলেমেয়েকে নিজেই মানুষকরেছেন । দু’জনেই এখন শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত ।

অঞ্জনা যেমন সাংবাদিক, তার দাদা অশোক তেমনই একটাবিনোদনমূলক বাংলা চ্যানেলের ক্রিয়েটিভ হেড । এক লাখের গন্ডিছাড়ানো মাইনে । সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে । মাসের মধ্যে বেশিটাসময়ই অশোককে কলকাতা-মুম্বাই করতে হয় । কারণ, ওদের হেডঅফিস সেখানেই ৷ অশোকের স্ত্রী দামিনী । প্রেমের বিয়ে। সুন্দরী, শিক্ষিতা। কিন্তু দশ বছরের ছেলে অর্পিতকে মানুষ করা ছাড়া আর কিছুইকরে না। হ্যাঁ, আর একটা কাজ করে । পরচর্চা ও পরনিন্দা । আসলে, দামিনী অত্যন্ত স্বার্থপর এবং আত্মকেন্দ্রিক। অন্যের ভালো দেখতে পারেনা। এই দামিনীর অত্যাচারেই অঞ্জনাকে সুখিয়া স্ট্রিটের পৈতৃক ভিটেছেড়ে বেহালার ‘বলাকা’-তে গিয়ে থাকতে হয়। আট বছরের মেয়েঅঙ্কিতাকে পাঠাতে হয় কার্শিয়ঙের ডাউহিল স্কুলে ।

অশোক আর অর্পিত তখন ব্রেকফাস্ট টেবিলে । তাড়াহুড়ো করছে।দামিনীও প্রায় রোবটের মতো ক্ষিপ্রগতিতে তাদের সার্ভ করে যাচ্ছে ।কারণ, অর্পিতের ড্রাইভার গতকাল থেকে অসুস্থ । ফুড পয়জন হয়েছে।তাই আসেনি । অশোক অর্পিতকে স্কটিশ-এ নামিয়ে সেক্টর ফাইভে যাবে। অফিসে । ছুটির পরে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসবে দামিনী ৷

এগিয়ে এসে টেবিলে বসলেন চিন্তাময়বাবু । অশোক বলল – ‘বাবা, কিছু বলবে?’

চিন্তাময় – ‘একটা খারাপ খবর আছে’ ।

অশোক – ‘কী হয়েছে?’

চিন্তাময় – ‘একটু আগে লতিফ ফোন করেছিল । বলল, অঞ্জুরবাড়ি ভেতর থেকে বন্ধ । কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আমিওফোন করে দেখলাম, অঞ্জুর দুটো মোবাইলই সুইচ্ড অফ । হট্‌ লাইনটাবেজে যাচ্ছে’ ।

হাতের ছুরি, কাঁটা থামিয়ে অশোক বলে উঠল – ‘সে কী?’

চিন্তাময় – ‘এখন ঠিক কী করা উচিৎ, বুঝতে পারছি না’ ।

অশোক – ‘কী আবার করবে? সোজা পুলিশকে ফোন করবে’ ।

দামিনী এতক্ষণ কথাগুলো শুনহিল। হঠাৎ শ্বশুরের দিকে একটুবাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল – ‘না, না। ওসব ফোন-টোন কিস্যুকরতে হবে না। দেখুন গিয়ে আপনার সেলিব্রিটি মেয়ে কাল রাতে পার্টিকরেছে। তাই বেশি মদ্যাপানের ফলে এখনও উঠতে পারেনি । খোঁয়াড়িকাটলে দেখবেন সব নর্মাল হয়ে গেছে’ ।

চিন্তাময়বাবু এবার একটু বিরক্ত হলেন ।

রাগতস্বরে বললেন – ‘এই সময় তুমি এভাবে কথা বলো না বৌমা’ ।

চুপ করে গেল দামিনী ৷

অবশেষে ফোন করলেন চিন্তাময় দাশগুপ্ত । তবে সরাসরি পুলিশকমিশনারকে নয় । লোকাল থানায় ৷ কারণ, তিনি ভাবলেন, ঘটনাটাসাধারণ হতে পারে । অযথা তার ক্যানভাস বড় করে কী লাভ?

পর্ণশ্রী থানার ওসি পুলক ব্যানার্জি চিন্তাময়বাবুর পরিচয় পেয়েগোটা ঘটনাটা মন দিয়ে শুনলেন । তারপর, বিনয়ের সঙ্গে বললেন,‘আপনি কোনও চিন্তা করবেন না স্যার। এক্ষুনি স্পটে যাচ্ছি। আমিঅঞ্জনা ম্যাডামকে চিনি’ ।

চিন্তাময় দাশগুপ্ত এবার ফোন করলেন লতিফকে, ‘তোমরা ওখানেআছ তো? পুলিশ আসছে । আমিও যাচ্ছি’ । 

বুক কাঁপানো টেনশনে লতিফ এতক্ষন ধরে গোটা দশেক সিগারেটশেষ করে ফেলেছে । এবার পুলিশের কথা শুনে সে একেবারেই ভেঙেপড়ল । মনে তখন তার একটাই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে, খুনের মামলায় ফেঁসে গেলে তার বিবি, বাচ্চা, আম্মার কী হবে? সে-ই তো সংসারেরএকমাত্র রোজগেরে মানুষ ।

এ এস আই যতীন বাগচী ও দু-জন কনস্টেবলকে নিয়ে পুলকব্যানার্জির জিপটা জোরে ব্রেক কষে দাঁড়াল ‘বলাকা’-র সামনে ।

লতিফ আর লক্ষ্মী এতক্ষণ সিঁড়িতে বসে ছিল । পুলিশ দেখে উঠেদাঁড়াল । পুলকবাবু বললেন, ‘তুমি লতিফ? আর তুমিই লক্ষ্মী ?’

দু-জনে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ’ ।

তারপর একজন কনস্টেবলকে পুলকবাবু অর্ডার দিলেন, ‘এদেরখেয়াল রেখো । আর মেইন গেটটা বন্ধ করে দাও । কেউ এলে আমাকেজিজ্ঞেস না করে খুলবে না’ ।

যতীন বাগচীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চারটে সিঁড়ি টপকে দরজারসামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বেল বাজালেন। একবার । দুবার ৷ তিনবার ৷কোনও উত্তর নেই । এবার বুটের টো দিয়ে দরজায় ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টাকরতেই হুট করে দরজাটা খুলে গেল । কপালে ভাজ পড়ল পুলকবাবুর ৷চোয়াল হল শক্ত । ঐ অবস্থায় তিনি ঘাড়টা ঘোরালেন লতিফ ও লক্ষ্মীরদিকে । তারা তখন বলির পাঁঠার মতো ভয় ভয় চোখে দরজাটার দিকেইতাকিয়ে আছে।

এক মুহূর্ত দেরি না করে, দুই অফিসার চকিতে ঢুকে গেলেন ভেতরে। ড্রযিংরুম, স্টোররুম, কিচেন, সার্ভেন্টস্‌ রুম, ওয়াশ রুম – সব তন্নতন্নকরে দেখলেন । কেউ কোথাও নেই। শুধু উপরে ওঠার সিঁড়ির মুখেকাদামাখা চটির দাগ পেলেন। উপরে উঠে তাঁরা বেডরুমের অবস্থা দেখেতাজ্জব । যতীনবাবু বিস্তারিতভাবে সব লিপিবদ্ধ করলেন । কিন্তক্লাইম্যাক্স তো ছিল স্টাডিরুমে । সেখানে পৌঁছে দু’জনে আবিষ্কারকরলেন নির্মমভাবে খুন হয়ে যাওয়া অঞ্জনা দাশগুপ্তকে ৷ পুলকবাবুআশ্চর্য হলেন একটাই কারণে, ইলেকট্রিক শক্‌ দিয়ে খুনের ঘটনাআজকাল সচরাচর দেখা যায় না । তাই এটাকে বলা যায়, সুপরিকল্পিতখুন বা প্রি-প্ল্যানড মার্ডার । কিন্তু এই ধরনের ‘কেস’-এ ওসি-র অভিজ্ঞতাও বুদ্ধিই শেষ কথা নয়।

পুলক ব্যানার্জি সরাসরি ফোন করলেন লালবাজার ওসি কন্ট্রোল-এ। সেখান থেকে খবর গেল দক্ষিন কলকাতার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারপ্রশান্ত ব্যানার্জির কাছে।

অর্থাৎ চিন্তাময় দাশগুপ্তর চিন্তাভাবনা অনুযায়ী ‘গোপন কথাটিআর রহিল না গোপনে’ । চালচিত্রটা বড় হয়েই গেল । আধ ঘণ্টার মধ্যে’বলাকা’-র বাইরে ও ভেতরে ‘কপু’ লেখা গাড়ি আর সাদা ইউনিফর্মগিজগিজ করতে লাগল । ডিসি সাউথ থেকে শুরু করে পুলিসকমিশনার, ডিসি ডিডি, কে নেই সেখানে! এসে গেলেন ফরেনসিকবিভাগের ফটোগ্রাফার । এবং অবশ্যই পুলিশ কুকুর ‘রকি’ । কুকুরটিএকতলা, দোতলা, বাড়ির চারিদিক ভালো করে শুঁকে, প্রথমে মেইন. গেট-এর বাইরে চলে গেল । শুঁকতে শুরু করল সেই জায়গাটা, যেখানেসকালে লতিফ মোটরবাইকের চাকার দাগ দেখেছিল । তারপর আবারভেতরে এসে রকি দোতলায় ওঠার সিঁড়ির প্রথম ধাপের কাছে কাদামাখাচটির দাগটা ভালো করে শুঁকে, বেড়িয়ে এসে কামড়ে ধরল লতিফেরপ্যান্ট ।

ইতিমধ্যে এসে পড়েছেন চিন্তাময় দাশগুপ্ত । সঙ্গে তার দলের একপ্রবীণ শীর্ষ নেতা ইন্দ্রাশিস লাহিড়ী। সব শুনে অসুস্থ হয়ে পড়লেনচিন্তাময়বাবু । এই অবস্থা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি । তাঁরচোখেমুখে জল ছিটিয়ে সুস্থ করে তুললেন বন্ধুটি ৷ ওদিকে ততক্ষণে বাইরেকৌতুহলীদের কল্পনা এবং চায়ের দোকানের জল্পনা বেশ জমে উঠেছে।সবাই নানারকম বিশেষজ্ঞের মতামত দিচ্ছেন । এদিকে, লতিফ ওলক্ষ্মীকে সোজা নিয়ে যাওয়া হল থানায় । কিন্তু পুলিস তাদের প্রচুর‘আদর-যত্ন’ করেও সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পেল না। তবে, লতিফ প্রথমেবাড়িতে ঢুকে ম্যাডামকে এ অবস্থায় দেখার কথাটা চেপে যাওয়ার চেষ্টাকরেছিল, পরে দু-চারটে ‘রুল-মালিশে’ স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হয়।দু’দিন পরে পুলিস দু’জনকেই ‘আবার ডাকা হতে পারে’ বলে ছেড়ে দেয় । কিন্তু একটা প্রশ্ন সবার মনেই দুলতে থাকে, খুনটা তাহলে করল কে বাকারা?

শেষে পুলিশ কমিশনার ব্রজেশ শর্মা ঠিক করলেন লোকাল থানানয়, এই ‘কেস’-এর তদন্ত করবে ডিকেটটিভ ডিপার্টমেন্ট ৷ ভার পড়লবিভাগের সবচেয়ে আস্থাভাজন অফিসার সম্রাট ঘোষের উপরে । যেমননায়কোচিত চেহারা, তেমনই দুঁদে গোয়েন্দা ।

চিন্তাময়বাবুর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় সম্রাট জানতে পারেন, অঞ্জনা দাশশুপ্তের স্কুলজীবন কেটেছে বেখুন কলেজিয়েট স্কুলে। পরেপ্রেসিডেন্সি কলেজ । সেখানে সে প্রেমে পড়ে সত্যব্রত দত্তর ৷ বৌবাজারেরপ্রখ্যাত ‘দত্ত জুয়েলারি’ ম্যানসনের মালিক বিশ্বম্ভর দত্তর একমাত্র ছেলে। রূপ ও অর্থ সম্ভবত এই দুই অমোঘ শক্তির টানেই অঞ্জনার এই ভালোলাগা, ভালোবাসা এবং শেষে বাবার অমতেই বিয়ে । কিন্তু দিন, মাস, বছর যত এগোতে লাগল, ততই কুষ্ঠর মতো ফুটে উঠতে শুরু করলসত্যব্রতর আসল চেহারা । জানা গেল, সে একটি মদ্যপ, লম্পট ৷সারারাত সোনাগাছিতে কাটিয়ে ভোরে বাড়ি ফিরে বৌকে বেধড়ক মারে ।এভাবে বছর চারেক চলার পরে অঞ্জনা তার দু’বছরের মেয়ে অঙ্কিতাকেনিয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হয় । পরে নাকি বিশ্বম্ভরবাবুসত্যব্রতকে ত্যাজ্যপুত্র করেন । এখন সে কপর্দকশুন্য । কিছুদিন আগেখোঁজখবর নিয়ে সে গড়িয়াহাটে অঞ্জনার অফিসে এসেছিল অর্থ সাহায্যচাইতে । বেশ কয়েকবার । অঞ্জনা তাকে তাড়িয়ে দেয় । একবার স্টাফদেরসামনেই বাকবিতন্ডা চরমে ওঠে ।

কিন্ত সত্যব্রতকে তুলে এনে জেরার পর জেরা করে সম্রাট বোঝেন, এই সাপের আর বিষ নেই । অতএব, তার নামের পাশে ক্রশ চিহ্ন এঁকেদেওয়াই ভালো ।

দ্বিতীয় সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি হলেন দিব্যকান্তি বসু । ‘লাইমলাইটগ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর মালিক । ‘নারী এবং’ পত্রিকার প্রধানসম্পাদক । বছর পঞ্চান্ন বয়স। যিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংবাদের তুলনায়ব্যবসাটাই বোঝেন ভালো । বিতর্কিত স্টোরি করা নিয়ে অঞ্জনার সঙ্গেবারকয়েক তার সংঘাত বেধেছিল। ‘না পোষালে ছেড়ে দিন’, এমন কথাওতার ঠোঁটে আটকায়নি ৷

সবচেয়ে বড় ঝামেলাটা বেধেছিল মাস চারেক আগে । গোসাবার’নিত্যানন্দ আশ্রম’ ও ‘হোম’-এর প্রধান নদেরচাঁদ মহারাজকে কেন্দ্রকরে । এই হোম থেকে প্রতিনিয়ত মেয়েদের ‘জলবেশ্যা’-র কাজ করতেবাধ্য করা হয় । সুন্দরবনের নদীতে, খাঁড়িতে যে ব্যবসা অত্যন্ত প্রাচীন ওগোপন । রাতের অন্ধকারে প্রতিটি ডিঙি নৌকো হয়ে ওঠে এক একটিনিশিনিলয় । হিন্দু, মুসমলমান সব ধরণের খদ্দেরই সেখানে স্বাগত।কিন্ত স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের তুষ্ট করে, নদের চাঁদমহারাজ সে সব খবর ‘ম্যানগ্রোভ’ পার হতে দিতেন না। গোপন সুত্রেএকথা জানতে পেরে অঞ্জনা তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং সাহসীরিপোর্টার ফাল্গুনী রহমানকে সুন্দরবনে পাঠান । মাত্র তিনদিনেরঅতিকষ্টকর প্রচেষ্টায় ফাল্গুনী বিস্তারিত খবর ও ছবি এনে অফিসে জমাদেয়। সেটাই হয় পাক্ষিক ‘নারী এবং’-এর কভার স্টোরি। চারিদিকে খুবহইচই পড়ে যায়। প্রচণ্ড রেগে ওঠেন দিব্যকান্তি বসু । তিনি জানান, এইনদেরচাঁদ মহারাজ নাকি তাঁর গুরুদেব । এই আশ্রমে তাঁর দানধ্যানওনাকি প্রচুর । একথাও বলেন, অঞ্জনা কাজটা ভালো করেননি । তিনিএর শেষ দেখে ছাড়বেন ।

দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করে দিব্যকান্তি বসুর কাছথেকে এসব কথা আদায় করেন গোয়েন্দা সম্রাট ঘোষ । কিন্তু খুনের কথাকবুল করানো সম্ভব হয় না । দিব্যকান্তি বারবার বলেন, আমি রেগে গিয়েপাঁচটা কথা বলতে পারি । গালমন্দ করতে পারি । কিন্তু খুন করব কীকরে!

এবার সম্রাট সরাসরি হানা দেন গোসাবায় । ‘নিত্যানন্দ আশ্রম’-এ। সদলবলে। কিন্তু সেখানে মহারাজের নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থাপনাদেখলে, মুম্বাইয়ের ডন-রাও ঘাবড়ে যাবে । ধীরে ধীরে সম্রাট সেই জালকেটে পৌঁছে যান নদেরচাঁদের মধুকুঞ্জে । মহারাজ চরম বিস্মিতহলেও, মুখে সেই অনাবিল হাসি ও ‘জয়গুরু’ বলে প্রথমে খানিকটাম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বহু জেরার পরে, সম্রাটের মগজাস্ত্রেরকাছে মানতে বাধ্য হন। আর ঠিক তখনই তাঁর নির্দেশে নেকড়ের মতোছুটে আসে একদল দেহরক্ষী । শুরু হয় গুলির লড়াই । একেবারেকর্মাশিয়াল সিনেমার স্টাইলে ৷ এবার বোঝা যায়, সম্রাটের আশেপাশে যারা এতক্ষণ ভক্ত সেজে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা আসলে পুলিশ । ধুরন্ধরনদেরচাঁদ এই সুযোগে পেছনের আন্ডারগ্রাউন্ড দরজা দিয়ে পালানোরচেষ্টা করেন । ঝাঁপিয়ে পড়েন সম্রাট । গুলি চালান মহারাজের পা লক্ষ্যকরে । মহারাজের হাতের অস্ত্র ঝলসে ওঠে। কিন্তু সম্রাটকে ছুঁতে পারে না। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় ।

গোসাবা থেকে নদেরচাঁদকে গ্রেপ্তার করে আনা হয় লালবাজারে।তারপর সেখানে শক থেরাপির মাধ্যমেই স্বীকারোক্তি আদায় করেনসম্রাট । নদেরচাঁদ কবুল করতে বাধ্য হন যে, জনগণের কাছে তাঁরমুখোশ খুলে নেওয়ার জন্য দিব্যকান্তি বসুই তাঁকে বদলা নেওয়ারপরামর্শ দিয়েছিলেন। মহারাজ তাই তাঁর পোষা গুন্ডা পাঠিয়ে অঞ্জনাদাশগুপ্তকে খুন করান। রক্তপাত তাঁর কাছে ‘অধর্ম’ বলে মনে হয়।তাই ইলেকট্রিক শক দিয়েই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন ।সেই দিনই ‘নারী এবং’ -এর অফিস থেকে দিব্যকান্তি বসুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ । 

পরের দিন সংবাদপত্রের হেডলাইন হয় ‘মহারাজ তোমারে সেলাম’ ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের অন্যান্য খবর
©বাংলাদেশবুলেটিন২৪