সুপ্রিয়া প্রিয়া জ্যোতি:
১.কিছুদিন যাবৎ রতনের কথা ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে।হয়ত অংক কষছি,চুল আঁচড়াচ্ছি,টিভি দেখছি বা বারান্দায় উদাস দাঁড়িয়ে আছি – হঠাৎ ই তার লোভাতুর চোখদুটো ভেসে উঠে আর ঘেন্নায় মনটা ভরে যায়।আমার সারা শরীরে পাক খায় বিচ্ছিরি এক অনুভূতি।দৌড়ে গিয়ে বাথরুমের বেসিনে উবু হয়ে এক দলা থুথু ফেলি।
চোখেমুখে পানি ছিটকে দেই।ট্যাপ থেকে অবিরাম কলকল পানি পড়ছে।আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখি।কি এমন পরিবর্তণ হয়েছে আমার যে সবাই এখন কেমন চোখে তাকায়।
রতনের মতো হাবা ছেলের চাহনিও অমন কুৎসিত হয়ে যায়।রতন আমার দূর সম্পর্কের ফুপাত ভাই।কিন্তু পারিবারিক ভাবে ওরা আমাদের খুব কাছের। রতন আর রথি পিঠাপিঠি দুই ভাইবোন।আমার বছর তিনেকের বড়।রথি কে আপা ডাকলেও রতন কে কখনো ভাইয়া বা দাদা ডাকিনি।ও লেখাপড়ার যেমন খারাপ তেমনি দেখতে, আচরণেও হাবাগোবা।লম্বায় ছিল আমার চাইতেও ছোট আর লিকলিকে শরীর।
আমরা ওকে তালপাতার সিপাহি বলে ক্ষেপাতাম।আমি যখন ক্লাশ ফোরে পড়ি রতন পড়ে সিক্সে।পর পর দুই বছর অংকে ফেল করে সিক্সেই পরে রইল।এদিকে আমি পাশ করে এগিয়ে যাওয়ায় দুইজন হয়ে গেলাম একই ক্লাশে।তবে আমাদের স্কুল ছিল আলাদা। আমি পড়তাম সিলভারডেল গার্লস স্কুলে।আর রতন জুবলী স্কুলে।
২.
আমরা থাকি ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিট রোডে।পুরনো বাড়ি।শুনেছি অনেক বছর আগে আমার দাদা এক হিন্দু লোকের কাছ থেকে বাড়িটি কিনেছিলেন।তারা এ বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় চলে গেছেন।
মায়ের কাছে শুনেছি।আমার দাদি ছিলেন বৃক্ষপ্রেমি। পুরো বাড়িতে আম,জাম,লিচু,নারকেল,সুপুরি গাছ দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে গিয়েছিলেন।বাড়ির সামনে ফুলের বাগান আর পিছনে সবজি দিয়ে পুরো বাড়ি ভরে ফেলেছিলেন।
হিন্দু বাড়িতে যে তুলসি গাছ থাকে সেটা অবধি কাটতে দেন নি।তিনি নাকি বলেছিলেন-” গাছের আবার হিন্দু মুসলিম কি গো!”
মা ও তাই শিখেছেন।বাড়ির গেইটেই দুপাশে লাগিয়েছেন মাধবিলতা।সবুজ পাতায় ছাওয়া সে মাধবিলতা, কি অপূর্ব! আমি যে ঘরটায় থাকি সে জানলা ঘেঁষে একটা হাসনাহেনা আছে।আর কাঠগোলাপ গাছটা বাড়ির দক্ষিণে।পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রক্তজবা,ঝুমকো জবা,শ্বেত জবা।মায়ের খুব ফুলের শখ কিনা তাই পুরো বাড়িতে ফুলের গাছ।এখন আর সবজি করা হয় না।সেখানে এখন সাত আটটা আকাশি,কড়ই,মেহগনির চারা পুঁতেছেন বাবা।মা বাড়ির নাম দিয়েছেন “সুখনীড়”। হলুদ দেয়ালে বাবা সবুজ নেমপ্লেট করে দিয়েছেন।
পুরো মহল্লায় আমাদের বাড়ি এক নামে সবাই চেনে।
আমার বাবা একমাত্র সন্তান বলে এ বাড়ি আর ভাগ হয়নি।আমরা ৪ ভাইবোন এ বাড়িতেই বড় হচ্ছি।আমার তিন ভাই।আমি সবার ছোট।মায়ের খুব মেয়ের শখ ছিল।আমার জন্মের পর তিনি
সব সময় বলতেন –
সংসারে মেয়ে না থাকলে চলে!মেয়েরা ঘরের শোভা বাড়ায়।সংসারের কাজে সাহায্য করে।ছেলেরা তো আর ঘরে থাকার মানুষ না।
৩.
ছোটবেলায় মা কখনো আমাকে আড়াল হতে দিতেন না।সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন।বাবা ছিলেন রেলের চাকুরে।জেলায় জেলায় ছিল পোস্টিং।তিনি সুযোগ বুঝে ঢাকায় আসতেন।আর যোগাযোগ করতেন চিঠি বা টেলিফোনে।আমাদের বাসায় টেলিফোন ছিলো না।ছিলো রতনদের বাসায়।বাবা প্রথমে ফোন করে বলে দিতেন,আবার কখন করবেন।রথি আপা এসে সময় বলে যেত।
মা সে সময় মতো আমাকে ফ্রক পরিয়ে সাথে নিয়ে যেত।আমিও ওদের ঘরে গিয়ে মায়ের পাশে বসে থাকতাম।রতন দূরে দাঁড়িয়ে দেখতো।আমি যদি বলতাম – এই রতন খেলবি?
সে মাথা নেড়ে দৌড়ে পালাত।তখন চুপ করে বসে বসে
দেখতাম কি সুন্দর করে রতনদের বাড়িটা সাজানো।
মেঝেতে কার্পেট,দামি ফার্নিচার, সুন্দর ছিটের পর্দা, রঙ্গিন টিভি,টেলিফোন।
দেখতাম আর মুগ্ধ হতাম।কথা শেষ করে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফেরার সময় মাকে বলতাম
-মা,রতনদের বসার ঘরটা কি সুন্দর না?
৪.
আমার যখন ১৩ বছর তখন পায়ের শেকল যেন আরো বেশি মজবুত হলো।আমার মনে আছে,সে বছর জন্মদিন গেল তার কিছুদিন পরেই আমার কি একটা হলো।পরে বুঝেছিলাম সেটা ঋতুস্রাব।কিন্তু
মা আমাকে এ ব্যাপারে কিছুই বুঝিয়ে বললেন না।আমি ভয়ে আতঙ্কে যখন কাঁদছি তখন শুধু বললেন-
“এসব কারুকে বলবি না খবরদার।সব মেয়েদের অমন হয়।শোন বড় হচ্ছিস।এখন থেকে আরো সাবধানে থাকবি।”
কি আশ্চর্য! বড় হলে সাবধানে কেন থাকব!আমার তো মনে হয় তাড়াতাড়ি বড় হলেই সুবিধে।স্বাধীন হওয়া যায়। এই যে দাদারা বড় হচ্ছে মা তাদের এখন একা একা সব করতে দিচ্ছে।বড়দা অন্য পাড়ায় ফুটবলব খেলতে যায়।
মেজদা তো সেদিন একা বন্ধুদের সাথে পিকনিকেও গেল।ছোটদা ছুটে বেড়াচ্ছে,এ বাড়ি সে বাড়ি যাচ্ছে অনায়েসে।আমার কোন অনুমতি নেই।এদিকে আমিও তো বড় হচ্ছি। অথচ আমাকে কিনা বলা হলো “আরো সাবধানে থাকবি!”
মা কিসের সাবধানের কথা বলতেন?তখন বুঝতাম না।তবে এখন বুঝি।রতন আমাকে ছুঁয়েছে পরে যে রকম বিচ্ছিরি অনুভূতি হয়েছে।তেমন অনূভুতি আমার আরো বেশ কয়বার হয়েছে।খারাপও লেগেছে। আবার ভুলেও গেছি।
কিন্তু সেসব আর ভুলে থাকতে পারলাম কই!বারংবার ঘুরে ফিরে কেউ না কেউ সে সব বাজে অনুভূতি গুলো জাগিয়ে দেয়।
৫.
প্রথম যেবার এমন অনুভূতি হলো তখন আমি ক্লাশ ফোরে পড়ি।বড় খালা মা কে বলেছিলেন
মা আর কথা বাড়ায়নি।ঠিক হলো প্রতিদিন আছরের পর পাড়ার মসজিদের ছোট হুজুরের কাছে দাদাদের সাথে পড়তে যাবো।আমার কি যে ভালো লাগছিল।সেখানে শেফালি,খুকু,তুলি,ওরাও পড়ে। মসজিদে মেয়েরা একপাশে আর ছেলেরা একপাশে বসে।
ওদের সাথে দুলে দুলে কোরআন পড়তাম।আর পড়া শেষে ওদের সাথেই গল্প করতে করতে বাসায় ফিরতাম।
একদিন হুজুর আমার পাশে এসে বসে বললেন
-তুমার নাম জানি কী?
আমি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম।পরের দিন থেকে রোজ মায়ের বড় ওড়নাটা মাথায় জড়িয়ে নীচের দিকটা ঝুলিয়ে দিলাম।হুজুর প্রায়ই সবাই কে পড়া দিয়ে আমার পাশে এসে গল্প করতে চাইতেন।সেই একই প্রশ্ন দিয়ে গল্পের শুরু
-তুমার নাম জানি কী?এইডা কেমুন নাম? ধুর ধুর,
নাম হইব আয়েশা,ফাতেমা,খাদিজা।
আমার এত রাগ হতো। আমার পাশে বসলেই হুজুরের গা থেকে আতর আর পান,সুপুরি,জর্দার একটা উৎকট গন্ধ নাকে আসত।
একদিন হলো কি,হুজুর ঠিক করলেন আমাদের সঠিক নিয়মে নামাজ শেখাবেন।হুজুর বললেন
-প্রথমে সবাই খারায়া পড়ো। নামাজের নিয়ত কইরা উভয় হাত কান পর্যন্ত ওঠাও। হেরপর তাকবিরে তাহরিমা কও। পরে বাম হাতের ওপর ডান হাত রাখো।পুলারা নাভির নীচে হাত বাঁধো।আমার মাইয়ারা বুকের উপর।
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে তার নির্দেশনা অনুসরণ করছি।
যথাবিহিত ছেলেমেয়ে আলাদা সারিতে।আমি এক কোনায় দাঁড়ানো।হুজুর হঠাৎ করেই আমার কাছে এসে এমন বিস্মিত হয়ে বলেন
৭.
আমাদের পাড়ায় আশেপাশের সবাই সবার বাড়িতে বেশ আসাযাওয়া! সাথে বাটি চালাচালি তো আছেই।ঘরে যাই রান্না হবে প্রতিবেশী কে ছাড়া যেন কারু মুখে রুচে না।বিশেষ করে মা ফুপুকে ছাড়া কিছুই খাবেন না।ফুপুও তাই।যা রান্না করছে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
গেল শবে-ব- রাতে আমার ফুপু।মানে রথি আপার মা এত অসুস্থ ছিলেন,যে কিছুই রান্না করতে পারেন নি।মা রুটি,বুটের হালুয়া,পায়েস,মুরগীর ঝোল আর পোলাউ রান্না করে আমাকে বললেন
রথি আপার কথা শুনে আমার খুব মজা লাগছিল।যদিও বাবলু কে আমি জানি না।তবে আন্দাজ করছিলাম হৃদয় ঘটিত কোন ব্যাপার হবে।
আমি মুখ টিপে হাসলাম।হাত ইশারায় বিদায় নিয়ে সবে তেতলার সিঁড়িতে এসেছি।দেখি রতন সামনে দাঁড়ানো।চোখমুখে একটা চোর চোর ভাব।
এ কয় বছরে রতন খুব বদলে গেছে।মেজদার সমান লম্বা।আগের মতোই চিকন তবে চোখমুখে হাবাগোবা ভাবটা নেই। সিঁড়ির পাশেই রতনের ঘর।
আমাকে দেখেই আস্তে করে বললো
উনার নাম পল্লব।এক সপ্তাহ যাবৎ আমাদের বাড়ি আছেন আজ চলে যাচ্ছেন।দারুণ হাসিখুশি আর মিশুকে গোছের মানুষ।লম্বা,সন্দুর স্বাস্থ্য চেহারায় বুদ্ধিদীপ্ত এবং আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট।
দাদাদের সাথে তো ভিষণ রকম বন্ধুত্ত্ব করে ফেলেছেন।মা ও পল্লবদার ব্যবহার,কথা,লেখাপড়ায় মুগ্ধ।এই সাত দিনে উনিই যেচে পরে আমার সাথে কথা বলেছেন। আমি উত্তর দিয়েই পালিয়েছি।তবে এটাও খেয়াল করেছি পল্লবদার ব্যবহার খুবই সাবলীল।এক টেবিলে বসে সবাই খেয়েছি, কখনো টিভি দেখেছি বা আড্ডায় বসে সবার কথা শুনছি।পল্লব দা কখনো গা ঘেঁষার চেষ্টা করেনি।
।স্থির দৃষ্টিতে আমার বুকের দিকেও তাকায়নি কখনো।
ভাবলাম যাক বাবা! সব পুরুষ মানুষ তবে এক নয়।
আজ যাওয়ার সময় আমার ঘরের কাছে এলেন বিদায় নিতে। আমাকে বললেন
বলেই হাসলেন।
আমিও মৃদু হাসলাম।পল্লব দা আবার বললেন-
-ওহ একটা কথা বলা হয় নি।ভিষণ মিষ্টি হাসি তোমার।
এত কম কম হাসো কেন?
বেশি বেশি হাসবে। হাসলে তোমাকে দেখতে দারুণ লাগে।
বলেই তিনি তরতর করে উঠোনের দিকে চলে গেলেন।
কথাটা শুনে আমার সারা গা যেন ঝনঝনিয়ে উঠল।একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ যেন পা থেকে মাথা অবধি ছড়িয়ে গেল।আমি দেখতে ভালো একথা অনেকের থেকে শুনলেও এত আনন্দ কখনো পাইনি।
আমি পল্লবদার ব্যবহারে অভিভূত হয়ে গেলাম।
৯.
পল্লবদা মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়ি আসেন।বাড়ির সবার সাথে তার এমন ভাব হয়েছে!আমিও এখন খুব গল্প করি।পল্লবদা এলেই মনে হয় বাড়ির মধ্যে যেন একটা টাটকা বাতাস ঢুকলো।
একদিন ভর দুপুরবেলা মা গেছেন রথি আপাদের বাড়ি।বড়দা ইউনিভার্সিটিতে, মেজদা টিউশনিতে আর ছোটদা ঘুমাচ্ছে।আমি এই অলস দুপুরে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম।হঠাৎ গেইটে কড়া নাড়ার শব্দ। গেইট খুলেই আমার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল।
পল্লবদা কে দেখে এত আনন্দ হচ্ছিল!বসার ঘরে আমরা গল্প করছিলাম।পল্লবদা আমাকে বললেন -দিশা চা খাবো।
ছুটে গিয়ে রান্না ঘর থেকে চা করে আনলাম।আমি চা খেয়েই যাচ্ছি।কিন্তু পল্লব দা চায়ের কাপে হাত অবধি ছোঁয়াননি।
বরং এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগলো।তবুও হাসি মুখ করে বললাম চা খাচ্ছেন না যে।
পল্লবদা উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন
আমার শরীর মন যেন চমকে উঠল।এ কন্ঠস্বর তো আমি চিনি।এভাবে তো রতন কথা বলেছিল।পল্লবদা তো এভাবে কখনো কথা বলেনি।
আমি কি বলে সেখান থেকে পালাব বুঝতে পারছিলাম না।
পল্লবদা আমার কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে নির্মিমেশ তাকিয়ে রইলেন।আমি হাত ছাড়িয়ে পালাতে যাবো তখনই তিনি আমাকে আরো শক্ত করে ধরলেন।আর বললেন
কোন রকম সেদিন সে বিশ্রি আলঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করেছিলাম।কত যে কাঁদলাম সে রাতে! যাকে ভালোবাসবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম,বন্ধু ভেবেছিলাম সেও কিনা এমন অসভ্যতা করল!নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম কেন খালি ঘরে একটা পুরুষ মানুষের সাথে গল্প করতে গেলাম! আমি কি জানতাম না এমন হতে পারত।খালি বাড়িতে আমি যে নিরাপদ নই এ কথা ভুলে গেলাম কি করে!হোক সে নিজের বাড়ি।
ভিষণ রাগ হচ্ছে নিজের উপর।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম বেঁচে থাকতে কখনো কোন পুরুষের প্রেমে পরব না।তারা যদি পায়ে পরে কাতর কন্ঠে প্রেম নিবেদন করে তবুও না। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের সম্মান করার পুরুষ যদি এ পৃথিবীতে না থাকে,তবে কি হবে সে প্রেম বা ভালোবাসার সম্পর্ক দিয়ে!