সুপ্রিয়া প্রিয়া জ্যোতি
ঠিক এই মুহুর্তে আফরা আমার কাছে বসে আছে।হাতের মুঠোফোন খানা বুকে নিয়ে কি ভিষণ ভাবেই না কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা।আমি আফরা কে দেখি আর অবাক হই কি অনিন্দ্য সুন্দর আর মনকাড়া তার মুখ।ওর ডাগর ডাগর চোখে জল উপচে পড়ছে।কিছুক্ষণ আগে ফোনে তুমুল কথা কাটাকাটি করে এখন সে অন্ধকারে বসে আছে।পুরো ঘর সূচীভেদ্য অন্ধকার।এই অন্ধকারে আমার মুখোমুখি বসে আফরা এক মনে কেঁদেই চলছে।তার না বলা দুঃখে অন্ধকার ঘরটা যেন থমথম করছে।
আমি মুক এবং নির্বাক।
আমার এই নিস্তব্ধতা তো আজকের না। সেই জন্মলগ্ন থেকে।আমি শুধু চুপ করে দেখেই যাই।
আচ্ছা আমার কথা থাকুক।
আফরার কথা বলি।
যখন ওকে প্রথম দেখি ওর বয়স কত হবে পনের কিংবা ষোলো। আমাকে পেয়ে সেই ষোড়শী যুবতীর সেকি উচ্ছাস!রাত,দিন,অমাবস্যা,পূর্ণিমা মদ্দাকথা সুযোগ পেলেই আমার মুখোমুখি এসে বসত।নিজেকে কি অপূর্ব করে সাজাতো।
একদিন সে শাড়ি পরল।চোখে কাজল,কপালে টিপ,পায়ে আলতা।আমি অবাক হয়ে ওকে আপাদমস্তক দেখেছিলাম। ওর মুখ, গ্রীবা,বুক,কোমড় দেখে আমার বুকের মধ্যে উন্মাদনা হয়েছিল।অদ্ভুত এক হৃদ স্পন্দন আমি টের পাচ্ছিলাম।
মাঝে মাঝে ও আমার সামনেই কাপড় বদল করত। আমার কিছুমাত্র অসংকোচ হয় নি কোন দিন।বরং আনন্দ পেতাম।আফরার উন্মুক্ত শরীর দেখে আমার সর্বাঙ্গে শিহরণ হতো।কিন্তু ওকে কখনো বলিনি।বললেও কি সে বুঝতে পারত!
আর বললেও কি মানুষ সব কথা বোঝে? তা ছাড়া আমি তো বলতেও পারতাম না।
আফরা যতো বড় হচ্ছিল ততো যেন ওর রূপ ছড়াচ্ছিল।ওর রূপে আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটত না।
একদিন হলো কি,গরমের এক মধ্যাহ্নে সে ঘরের কোনার মেঝেতে উপুর হয়ে শুয়ে মহাদেব সাহার কবিতা আওড়াচ্ছিলো।আমি এক মনে দেখে যাচ্ছি।এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।আমি তখনো দেখেই যাচ্ছি।কি একটা আকর্ষণ ওর দেহখানিতে।শরীর টা এমন ভাবে আছে যেন একটা প্রবাহমান নদী কমোরের কাছে এসে বাঁক নিয়েছে।সে নদীর কূলে কূলে উদ্দাম ছড়ানো।আলুথালু শাড়িটা যেন ঠিক এই মুহুর্তে আমার কাছে মর্মান্তিক রকমের অসহ্য লাগছে।মুখের ওপর চুলের কিছু অংশ লেপ্টে পড়ে আছে।কি অপূর্বই না লাগছে।
হঠাৎ ওর ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে এসে আবার আমার মুখোমুখি বসল।ওর ঘুম ভাঙ্গা চোখ দুটো থেকে আমি চোখ ফিরাতে পারছিলাম না।অন্যমনস্ক হয়ে আফরা একবার আমার উপর ওর হাত রাখলো।আমার সমস্ত শরীরে এমন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো, তা কি সে বুঝল?
বুঝল না।
আমারও বলার মতো ভাষা নেই।
কোনদিন তাকে কিছু বলিনি।অথচ এই ঘরে আমিই ওর সার্বক্ষনিক সঙ্গি।
ওর সুখ,দুঃখ, আনন্দ,অবসাদ,উত্তেজনা সব কিছু আমিই সবার আগে জানি।আর সমস্ত প্রাণ দিয়ে আফরাকে অনুভব করি। অথচ এক মুহূর্তের জন্যেও সে কখনো আমার কথা ভাবে না।
ঠিক এই রকম অনুভূতি আজ হতে আরো একশ বছর আগে আমার আরো দুজনের জন্যেও হয়েছিল।
জমিদার নবীন কিশোর তার প্রিয়তমা পত্নী শ্রীমতি মধ্যমার জন্য আমাকে উপহার হিসেবে গড়তে বললেন।চারপাশে কারুকাজ মন্ডিত পুরু কাঠের ফ্রেমে আমাকে বসানো হলো।সাবেকি ধাঁচের নকশা করা এই ড্রেসিংটেবিল পেয়ে জমিদার পত্নীর খুশি যেন ধরে না।আমিও এই নারীকে পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম।সকাল সন্ধ্যা সে আমার সামনে নিজেকে সাজাতো।আর আমি মুগ্ধ নয়নে তাকে দেখতাম।
মধ্যমার মধ্যে আশ্চর্য এক আভিজাত্য ছিল।কপালে সিঁদুর, টিপ,চোখে কাজল, ঠোঁটে পান,বাহারি গহনা আর শাড়িতে আভিজাত্য ছড়িয়ে পড়ত। পুরো ঘরে সুন্দর একটা সুবাস থাকতো ।সেজেগুজে অধির হয়ে অপেক্ষা করত স্বামীর জন্য। আর আমি চোখের সামনে তাদের প্রেম সম্মেলন নীরবে দেখতাম।
পতিপত্নীর এই আনন্দ আমাকে কি ভিষণ কষ্ট দিতো!
একদিন কি অভিমানে মধ্যমা আমার সামনে সারা গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলো।আমি তাকিয়েই রইলাম।
চোখের সামনে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখলাম আমার প্রেয়সীকে। কি, বীভৎস!
কি যন্ত্রনার সে মৃত্যু!
আমি নির্বাক পাথরের মতো চেয়ে চেয়ে দেখলাম ওর সুন্দর শরীরটা আগুনে জ্বলে খাক হচ্ছে।
চিৎকার করার বা তাকে আটকানোর ক্ষমতা আমার নেই।
পুরো বাড়িতে তখন এই অপঘাতের মৃত্যু নিয়ে হৈ হৈ।এ ঘরে সবার আসা নিষিদ্ধ হয়ে গেল।আমি একা পড়ে রইলাম।একেবারে নিঃসঙ্গ।
অনেক দিন পর জমিদার বাবু এক পুরোহিত মশাইকে ঘরে নিয়ে এলেন।তিনি ঘরে কি সব পূজাপাঠ করলেন। আমার সামনে এসে তীক্ষ্ণভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেই।আর সবাইকে বোঝালেন,
-“হিন্দু শাস্ত্র মতে, আয়না মানুষের আত্মার অংশকে তার ভিতরে ধরে রাখে। আর অপঘাতে মৃত্যু হলে তো কথাই নেই।আবার যখন দেবতা বা অপদেবতারা কোনও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান, তাঁরা আয়নার মাধ্যমেই তা করতে থাকেন। ফলে আয়না এই আয়নাটা এই ঘর থেকে সরাতে হবে।”
আমাকে সাদা কাপড়ে মুড়ে রাখা হলো।কত দিন, কত বছর আমি জানি না।ভেবেছিলাম আমার জীবন পথের যাত্রা এখানেই শেষ।
কিন্তু একদিন আমার গায়ের সাদা কাপড় কেউ একজন তুলে নিল।আমি তখন সাজানো গোছানো এক ঘরে।আমার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছেন তার রূপ বর্ণনাতীত।এত বছর পর কাউকে সান্নিধ্যে পেয়ে আমি রীতিমতো আপ্লুত। মনে হচ্ছে এটা সত্যি না, যেন কোন মহামায়া।
বুঝতে পারলাম যিনি আমাকে কিনে এনেছেন তিনি এই বাড়ির মালকিন।তার নাম মেহেরজান।
প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা তিনি নিজেকে অপরূপ করে সাজিয়ে তুলতেন।
আবার আরো এক নারীর ভুবন ভোলানো হাসি আর সুন্দর দেহবল্লরীর প্রেমে পড়ে গেলাম।প্রতি রাতেই যেমন এক এক পুরুষ তার প্রেমে মজেন।
একটা ছেলেকে মেহেরজান ভালোবেসেছিল। সমাজে মেহের ঐ ছেলের স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি চেয়েছিল।তার কাছে অন্যান্য পুরুষদের আনাগোনা বন্ধ করে দেয়।এক মনে একটা সংসারের স্বপ্ন দেখে।কিন্তু
ছেলেটি তাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।আর মেহের এক সময় তা বুঝতেও পারলো।
তখন না সে খুব কেঁদতো। আমার যে কি মায়া হতো!
ইচ্ছে করত আদরে আদরে ওর কান্না মুছে দিতে।
মেহেরজানের একাকিত্ব, কান্ন আমার সহ্য হতো না।
যাহোক,একদিন মেহের সিদ্ধান্ত নিলো।বাইজিপাড়া ছেড়ে সে হজ্জ করে বাকিজীবন আল্লাহর ইবাদত করবে।আর তার সব সম্পত্তি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ওয়াকফ করে দিবে।
তাই করলো।পুরো বাড়ির আসবাব তুলে দিলো নিলামে।সেখানে আমিও ছিলাম।
আমার জীবনে মেহেরজানের পাঠও চুকে গেল।
আমার জায়গা হলো পুরনো এন্টিক আসবাবে ঠাসা এক দোকানে।
সেখানেও কেটে গেল বেশ অনেক গুলো বছর।
হঠাৎ একদিন আমার জীবনে নব বসন্তের মতো আফরা এলো।
আফার বাবা আমাকে রংপুরের এক পুরনো আসবাবের দোকান থেকে মেয়ের জন্য কিনে আনলেন।জানতে পারলাম আফরার পুরনো আসবাবের শখ।
আমি দেখতে কেমন জানিনা।
কিন্তু এ যাবৎ আমি যে সকল মানবী দেখেছি তারা প্রত্যেকেই সুন্দর। আর সুন্দর তো হবেই কারণ আমার দিকে তাকালে তারা নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায়।যে টুকুন খুঁত চোখে পড়ে সেটাকে পরম যন্ত নিয়ে ঠিক করে নিজেকে আমার সামনে অত্যন্ত পরিপাটি করে উপস্থাপন করে।
আর কল্পনা বিলাসি আমি বারংবার সে সব মানবীর প্রেমে মশগুল হয়ে পড়ি।আদতে আমার জীবনের সকল মানবী ছলনাময়ী।অথচ তাদের অন্তরের সমস্ত নিগূঢ় কথাই আমি জানি। কিন্তু এই অক্ষমের জন্য কে ভাবে!
আমি যে সামান্য আয়না মাত্র।
কিন্তু আমার ভিতরের লুকানো যে সত্তা আছে তা
প্রেম জাগায় , কাম জাগায়। আসলে লোকে তো জানে না, আমি নেহাত আয়না নই।
আমি তো পুরুষও বটে।
মধ্যমা,মেহেরজান, আফরা একে একে যারা এসেছিল আমার জীবনে এবং যারা আসবে ওরা কখনোই আমাকে আবিষ্কার করতে পারবে না।
কারো পক্ষেই তা সম্ভব নয়।
ওরা আসবে আবার চলেও যাবে।
আর আমি?
আমি ঘুমাই।মরি না, বেঁচে থাকি, জাগি আবার ঘুমাই। স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন কি মিথ্যা? কল্পনা? কোনটা মিথ্যা?