স্টাফ রিপোর্টার-
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল জোটগতভাবে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পরও আসন বণ্টন নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরে জানানো হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে চারটি দলের প্রধানদের ৪টি আসনে ছাড় দেওয়ার সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। জোটের শরিক দলগুলো সরকারি দলের সঙ্গে থেকে গত ১৫ বছরেও নিজেদের শক্তিশালী করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত রাখার কথা জানিয়ে সবাইকে জিতে আসার কথা বলেন তিনি।
বৈঠক সূত্র জানায়, সোমবার (৪ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে সন্ধ্যা ৬টায় বৈঠক শুরু হয়, যা রাত পৌনে ১০টায় শেষ হয়। বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর জোটের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, তরিকত ফেডারেশনশের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারিসহ জোটের নেতারা বক্তব্য রাখেন।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, জোট নেত্রী উন্মুক্ত নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলেন, নির্বাচন উৎসবমুখর করতে সকল আসনই উন্মুক্ত থাকুক। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবাই জিতে আসুক। শরিকেরা নৌকা প্রতীক নির্বাচন এবং আসন ছাড়ের প্রত্যাশার কথা জানান। বৈঠকে জোটের শীর্ষ নেতাদের আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে ১৪ দলীয় জোটের প্রয়োজনীয়তা আছে। তাই জোটগতভাবেই নির্বাচন করবে ১৪ দল। আসন ছাড়ের ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। এ জন্য জোটের মুখপত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে একটি কমিটি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জোটের আসন বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসন আমুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিমকে জোটের দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে বলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, জোটের শরিক দলগুলোকে এবার আসন ছাড় দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। সে কারণে কোনও আসনে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করবে না দলটি। জোট শরিকদেরও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তবে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে বরিশাল-২ বা ৩, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে পিরোজপুর-২, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে কুষ্টিয়া-২ ও তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে চট্টগ্রাম-২ আসনে ছাড়ের সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন। এ ছাড়া জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতারকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য করা হতে পারে।
১৪ দল সূত্রে জানায়, এবার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) আসন চেয়েছে ৮টি। বর্তমানে দলটির সংসদ সদস্য আছেন ৩ জন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি আসন চায় ৭টি। এই সংসদে দলটির সংসদ সদস্য আছেন ৩ জন। তরিকত ফেডারেশনের বর্তমানে একজন সংসদ সদস্য থাকলেও এবার ৫টি আসন আশা করছে। জাতীয় পার্টি (জেপি) ৫টি আসন দাবি করলেও, বর্তমানে দলটির একজন সংসদ সদস্য আছেন। সাম্যবাদী দলের কোনও সংসদ সদস্য না থাকলেও, এবার একটি আসন চায় তারা। জোটের বাকি শরিক দলগুলোর বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই, তাদের প্রত্যাশাও কম।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, জোটগতভাবে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয় চূড়ান্ত হয়েছে। আসন বণ্টনের বিষয়টি আমির হোসেন আমু ভাই আর ওবায়দুল কাদের বসে ঠিক করবেন বলে জানানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে বৈঠকে ১৪ দলের নেতাদের উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। স্যাংশনও আসতে পারে। তবে নির্বাচন যথাসময় হবে। নির্বাচনের পর নতুন সংকটের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। আমি বেঁচে থাকলে এ থেকে উত্তরণ করবো।
বৈঠকের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, শ্রমিক ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। এত কম মূল্যে শ্রমিক কোথায় পাবে, আমিও দেখবো। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত চললেও আমি ভয় পাই না।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নির্বাচনে জোটগতভাবে এবং নৌকা প্রতীকে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে আসন বণ্টন নিয়ে চূড়ান্ত কিছু জানানো হয়নি। আসনের বিষয় আমু ভাই কথা বলে ঠিক করবেন।
তিনি বলেন, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু ও দিলীপ বড়ুয়াকে মন্ত্রী বানানো হলেও আমাকে মূল্যায়ন করা হয়নি। আমাকে মন্ত্রী বানানো হলে পাঁচ বছরে আমার সংগঠন কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো! আর নৌকায় নির্বাচন করতে হতো না। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের জোটের ‘প্রয়োজনীয়তা’ এবং ‘প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা’ নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে বলেছি, এতে আমরা আশাহত ও মর্মাহত হয়েছি।
বৈঠক সূত্রমতে, ১৪ দলের শরিক দলগুলোর সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরেও দল ঠিক করতে পারেননি। দলকে শক্তিশালী করেন। নতুন নতুন কত দল আসছে। এ সময় জোট নেতারা বলেন, অন্য কোনও দলের সঙ্গে মেলালে হবে না। জোটের দলগুলোর একটা আদর্শিক পরিচিতি আছে। ছোট বলেই নৌকায় নির্বাচন করতে চাই।
বৈঠকের বিষয়ে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ১৪ দলের গুরুত্বটা বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। জোটের দরকার আছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আদর্শিক এই জোটকে এগিয়ে নিতে হবে বলেছেন তিনি। দেশে আমেরিকার আজ্ঞাবহ একটি সরকার আনার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা রুখে দিতে হবে বলেও উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনা।
আসন বণ্টনের বিষয়ে তিনি বলেন, বৈঠকে আসন বণ্টন নিয়ে সবাই (জোট শরিকরা) বলেছেন। তবে জোটনেত্রী কিছু বলেননি। এ ব্যাপারে পরে জানানো হবে বলা হয়েছে। আমরা চট্টগ্রাম আসনে ছাড় চেয়েছি।
১৪ দলের বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, এ বিষয়ে মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টায় ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ব্রিফ করে জানাবেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছিল, ১৪ দলের বৈঠকের বিষয়ে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি কার্যালয়ে ব্রিফ করবেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। পরে দলটির দফতর থেকে জানানো হয়, বৈঠক শেষ না হওয়ায় সোমবার ব্রিফ করা হয়নি। মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) দুপুরে ব্রিফ করবেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলের বৈঠক হয়েছে বলে জানা গেছে। বৈঠকে ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জাতীয় সমাজতান্ত্রীক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, গণতান্ত্রিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেনসহ জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা অংশ নেন।