পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাবার শিক্ষাই তো সভ্যতার সমৃদ্ধি-সুরভি দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষ্য- ‘সৃজনশীল, সুস্থ, সংযমী উদ্ভাবনী শক্তিই শিক্ষা যা নতুন জীবনের সুবাতাস আনে।’ রংপুরের মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার দৃঢ়প্রত্যয়ী চাওয়া-‘আত্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে নারীর মুক্তি নারীকেই অর্জন করতে হবে।
আর তার জন্য সবার আগে চাই শিক্ষা।’ এ শিক্ষাক্ষেত্রে রংপুর এখন অনেক এগিয়ে। শিক্ষার পথযাত্রা সূচনা দূর অতীত থেকেই। যদিও প্রাচীন সময়ের পূর্ণ তথ্য মেলে না, তবু বলা যায় স্থানীয় ব্যবস্থায় পাঠশালা, চণ্ডীমণ্ডপ, গুরুগৃহ, টোল, মসজিদকেন্দ্রিক শিক্ষার সুযোগ ছিল। বৈদিক যুগে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্ত ও সন্ন্যাস এমন চতুরাশ্রমে শিক্ষা দেওয়া হতো। অহিংস বৌদ্ধ ধর্মেও কাঠামোতে ছিল সঙ্ঘরাম বা বিহারকেন্দ্রিক শিক্ষা।
সুলতানি, পাঠান, মোগল আমলে ‘দরস’ এ শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনায় ভারতবর্ষে শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলেকে সাতটি স্তরে ভাগ করে শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে। এমন ধারাবাহিকতায় রংপুর জেলার শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম স্বচ্ছচিত্র মেলে কানুনগোদের প্রতিবেদনে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে। এডাম রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী, ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে রংপুরের উনিশটি পুলিশ সার্কিটের ১৪টিতেই কোনো প্রাথমিক স্কুল ছিল না, বাকি পাঁচটি সার্কিটে দশটি বাংলা, এবং দুটি ফার্সি স্কুল ছিল।
তবে জেলার নয়টি সার্কিটে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য ৪১টি টোল ছিল যার প্রতিটিতে পাঁচ থেকে পঁচিশজন করে ছাত্র ছিল।
১৯৪৭ সালে রংপুরে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল এক হাজার আটশ একচল্লিশটি। একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন বঙ্গবন্ধু। ছত্রিশ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করা হয়।
সারা দেশের মতো রংপুরের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের আওতায় আসে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করলে রংপুরেও বেশকিছু স্কুল সরকারি হয়ে যায়। শিক্ষার মান উন্নয়নে দরকার বহুমুখী পদক্ষেপ। ১৯৪৭-এ রংপুরে মাধ্যমিক স্কুল ছিল ১৯৮টি। এখন সে সংখ্যা বহুগুণ বেশি।
রংপুরে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় জমিদারদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জমিনদারস স্কুল।’ রংপুরের কুণ্ডির জমিদার রামমোহন রায় চৌধুরীসহ অনেকের সহযোগিতায় কার্যক্রম চলে স্কুলটির। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে নাম ধারণ করে রংপুর জিলা স্কুল। এ সময় সরকারিকরণও হয় স্কুলটি। স্কুলটির শুভ উদ্বোধন করেন সে সময়ের ভারতের বড়লাট লর্ড বেন্টিক।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিক শিক্ষা বিস্তারের যে ব্যাপক পরিকল্পনা করেন তা শিক্ষা বিস্তারে ম্যাগনাকার্টা হিসেবে বিবেচিত। ধারণা করা হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ’৬২ পর্যন্ত স্কুলটির শিক্ষার মাধ্যম ছিল-সংস্কৃত, ইংরেজি এবং পার্সিয়ান ভাষা। প্রতিষ্ঠার পনেরো বছরের মাথায় আগুন লেগে পুড়ে যায় বিদ্যালয় ভবন। স্থান পরিবর্তনের পালা শেষে নতুন সাজে যাত্রা শুরু হয় জিলা স্কুলের।
নারী শিক্ষার পরিধি বিস্তৃত করতে কাকিনার বিখ্যাত জমিদার মহিমারঞ্জন রায়ের প্রয়াসে রংপুরে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। এখন রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বহু বালিকা বিদ্যালয় মেয়েদের শিক্ষার আলো বিলিয়ে চলেছে।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৮৭৭-এর পহেলা জানুয়ারি রংপুর জিলা স্কুলে নয়জন ছাত্র নিয়ে কলেজ শাখা চালু হলেও তিন বছরের মাথায় ছাত্রাভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
রংপুরে উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত করতেই প্রতিষ্ঠা কারমাইকেল কলেজের। স্থানীয় বিদ্যানুরাগী, জমিদারদের উদ্যোগে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর ভিত্তি স্থাপিত হয় কলেজটির।
দৃষ্টিনন্দন অক্সফোর্ড ভিলেজের আদলে ইন্দো-স্যারাসনিক স্থাপত্যে নির্মিত কলেজটির মূল ভবন। প্রতিষ্ঠাকালে জমির পরিমাণ ছিল নয়শ বিঘা। এর মধ্যে পঁচাত্তর একর জমি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম সূচিত হয় জুলাই ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে।
কলেজ ভবন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চলে রংপুর জেলা বোর্ড কার্যালয়ে। কারমাইকেল কলেজ সরকারিকরণ হয় পহেলা জানুয়ারি ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে। প্রতিষ্ঠার পর এটি ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। আইএ ও বিএ খোলা হয় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯২২-এ আইএসসি, বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ইংরেজি, ফার্সি, দর্শন, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, মানবিক ও নৈতিক দর্শন, গণিতসহ কিছু বিষয়ে অনার্স খোলার অনুমতি দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বিএসসি কোর্স চালু হয় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৪৭ থেকে ৫২ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৩ থেকে ’৯২ পর্যন্ত রাজীশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল কলেজটি।
বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। আঠারোটি বিষয়ে অনার্স, পনেরোটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্সে পড়ানো হচ্ছে। আছে উচ্চ মাধ্যমিক কোর্স। কলেজের গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ, আছে শহীদ মিনার, মসজিদ, একাডেমিক ভবন, রসায়ন ভবন, আইসিটি ভবন, উচ্চ মাধ্যমিক ভবন, বিজ্ঞান ভবন। প্রায় পঁচিশ হাজার শিক্ষার্থী কলগুঞ্জনে মুখর থাকে কলেজটি।
কারমাইকেল কলেজে পড়ালেখার পাশাপাশি আছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ। স্পন্দন, বিতর্ক পরিষদ, কারমাইকেল নাট্য-সাহিত্য সংসদ, কাইজেলিয়া শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদ, বাঁধন প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। প্রশাসনিকভাবে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। জাতীয় দিবসগুলো পালিত হয় যথাযথ মর্যাদায়।
ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক-ছাত্রদের ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়, অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ সোলায়মান, আব্দুর রহমান, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায়, অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, মুখতার ইলাহী, শরিফুল আলম, গোলাম গৌছ। কারমাইকেল কলেজের মূল সংকট শ্রেণিকক্ষ। আছে আবাসিক সংকট। ছাত্রাবাসগুলো অনেকদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মেসে থেকে পড়ালেখা করতে হচ্ছে।
ইতোমধ্যে শতবর্ষ অতিক্রম করেছে কলেজটি। শতবর্ষ উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। দাবি আছে দ্রুত শতবর্ষ অনুষ্ঠান আয়োজনের। সংকট যেমনই থাক প্রতিষ্ঠার পর থেকে কারমাইকেল কলেজ রংপুর অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।
রংপুরে কারমাইকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। নানা কারণে তা যখন হয়নি তখন আন্দোলন হয় স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি দেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের জমিতে। পরবর্তী বিএনপি সরকার তা বাস্তবায়ন না করায় বিশ্ববিদ্যালয়টি রংপুরে প্রতিষ্ঠা পায়নি। অবশেষে ২০০৮-এর ১২ অক্টোবর রংপুরের মানুষের স্বপ্নের রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন হয় ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল।
২০১১ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি রংপুরের মডার্ন মোড় রংপুর ক্যাডেট কলেজের উত্তরে কারমাইকেল কলেজের পঁচাত্তর একর জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাসের উদ্বোধন হয়। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করলেও ২০০৯-এ নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্মরণে নামকরণ করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। রংপুর বিভাগের পূর্ণাঙ্গ একমাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এটি।
বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবষণার মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতে নেতৃত্বদানকারী মানবসম্পদ সৃষ্টি।
রংপুরে বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আশা করি ভবিষ্যতে রংপুরের কেউ নিরক্ষর থাকবে না।