জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশে—বাড়ছে তাপমাত্রা, ঘন ঘন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ। উক্ত পরিস্থিতির কারণ, ভয়াবহতা এবং উত্তরণের পথ নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ইফতেখার মাহমুদ।পরিবেশ সাংবাদিকতায় তার দীর্ঘ সময়ের পথচলার অভিজ্ঞতা রয়েছে।সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলাদেশ বুলেটিনের প্রতিবেদক মোঃইকরামুল হাসান।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের জলবায়ুর কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে?
ইফতেখার মাহমুদঃ প্রাথমিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ধারণাগত এবং বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন লক্ষণীয়।স্বভাবতই এই দুটি বিষয়ে আমরা শতভাগ নিশ্চিত না হলেও দেখা যাচ্ছে যে মূলত বাংলাদেশে ফ্রিকোয়েন্সির ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনটি দৃশ্যমান।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ কার্বন নিঃসরণ এবং শিল্প কারখানার দূষণ বাংলাদেশের জলবায়ুকে কীভাবে প্রভাবিত করছে?
ইফতেখার মাহমুদঃ কার্বন নিঃসরণ ও শিল্প কারখানার দূষণ বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের অনিয়মিততা ও জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। যার ফলাফলস্বরূপ বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ কীভাবে বেড়েছে?
ইফতেখার মাহমুদঃ প্রথমে যদি ঘূর্ণিঝড় প্রসঙ্গে আসি তাহলে দেখা যাচ্ছে এটির মাত্রা পূর্বের ন্যায় অনেক বেড়েছে এবং বাংলাদেশে প্রতিবছর একাধিক ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে যা আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগেও গড়ে ৩-৪ বছরে ১টির বেশি হতো না। অন্যদিকে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ঘন ঘন শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হওয়ায় জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপও বেড়েছে। এছাড়া বন্যার পরিমাণ ও তীব্রতা দুটিই ঊর্ধ্বগামী হওয়ায় এর প্রবণতাও পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়েছে।গত বছরে ফেনী, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জে,হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম এবং খাগড়াছড়ি জেলায় আকস্মিকভাবে সংগঠিত হওয়া বন্যা এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ বনভূমি ধ্বংস এবং অবৈধ দখল জলবায়ু পরিবর্তনে কীভাবে ভূমিকা রাখছে?
ইফতেখার মাহমুদঃ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বন ও জলাভূমি আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রধান সঙ্গী হওয়ার কথা। সাধারণত একটি দেশে বনভূমির পরিমাণ ২০% থাকার কথা বলা হলেও বর্তমানে আমাদের ১৩% এর মতো রয়েছে।যার মধ্যে ৮-৯% বন বেষ্টিত এলাকা এবং প্রাকৃতিক বনের কথা আসলে আমার ধারণা এটি ৪-৫% এসে দাড়াবে। কেননা, বাংলাদেশের মতন একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সময়ের পরিক্রমায় অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন বৃদ্ধির ফলে অবাধে গাছপালা কেটে ফেলা, নদ-নদী দখল এবং পরিবেশ দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এছাড়া, জলাভূমি ও উজানের পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় তাপমাত্রাও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আপনি যতি গরমের সময় রাজধানীর রমনা পার্ক অথবা কোন বহুতল ভবনে যান তাহলে আপনি সেখানে প্রবেশ এবং প্রস্থানের সময়কার তাপমাত্রার বিস্তর পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারবেন।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলো কী কী?
ইফতেখার মাহমুদঃ প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি, বন উজাড়, এবং শিল্প ও যানবাহনের দূষণ যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত করছে। নদীভাঙন, লবণাক্ততার বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করছে। পাশাপাশি, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন ও অপরিকল্পিত কৃষি কার্যক্রম পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা জলবায়ুর পরিবর্তনকে আরও তীব্র করছে।সুতরাং, মানবসৃষ্ট ও প্রকৃতিগত কারণগুলোর ফলেই আমরা প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার সম্মুখীন হচ্ছি।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ কৃষি ও মৎস্য খাতে এর কীরূপ প্রভাব পড়ছে?
ইফতেখার মাহমুদঃ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও আকস্মিক বন্যার জন্য কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এতে ফসলের ক্ষতি, মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া ও খাদ্য সংকটের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। পাশাপাশি, মৎস্য খাতে নদ-নদীর জলস্তর পরিবর্তন ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাছের প্রজনন ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে জেলেদের জীবিকা ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে নদী ভাঙনের পরিমাণ প্রায়শই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উদ্বাস্তু সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে, এটির সমাধান হিসেবে কীরূপ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
ইফতেখার মাহমুদঃ প্রথমত,বনায়ন বৃদ্ধি ও তীর সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি, যা মাটি ক্ষয় রোধে সহায়তা করবে। দ্বিতীয়ত,টেকসই বাঁধ ও নদী খনন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভাঙনের প্রবণতা কমানো যেতে পারে। তৃতীয়ত,কৃষি ও জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।সর্বোপরি, জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো ও বাসস্থান উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে উপকূলীয় জনগণের জীবনমান উন্নত করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ জনস্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
ইফতেখার মাহমুদঃ চরম আবহাওয়া ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা পানিবাহিত রোগ, ডায়রিয়া ও ত্বকের সমস্যার কারণ হচ্ছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা ও লবণাক্ততার বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদন হ্রাস করছে, ফলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। নদী শুকিয়ে যাওয়া ও লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ সুপেয় পানির সংকট বাড়াচ্ছে, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মোকাবিলায় কার্যকর অভিযোজন ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
ইফতেখার মাহমুদঃ ব্যক্তিগতভাবে গাছ লাগানো, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সাশ্রয়ী পদ্ধতি অনুসরণ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে কার্বন নিঃসরণ কমানো যেতে পারে। প্লাস্টিক ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব। সামাজিকভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি ও টেকসই নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়াও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও দূষণ রোধে স্থানীয় পর্যায়ে কার্যক্রম নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি, জলবায়ু নীতি বাস্তবায়নে সরকার, সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এর যথোপযুক্ত ও সময়োপযোগী কাজ সম্পন্ন করা জরুরি।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর জন্য সরকারের পাশাপাশি বৈশ্বিকভাবে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?
ইফতেখার মাহমুদঃ সর্বপ্রথম জাতিসংঘকে প্রতিটি দেশের স্থানীয় পরিস্থিতি এবং সমস্যাগুলো সার্বিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে যে রাষ্ট্রের যতটুকু দায়ভার রয়েছে সেই অনুযায়ী একটি আইনি বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে দায়িত্ববোধের জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। এবং সেটি বাস্তবায়ন তরান্বিত করার অন্যতম পন্থা হতে’ পারে ‘প্যারিস চুক্তি’, যা ১৯৫ টি দেশের বৈশ্বিক ঐকমত্যের মাধ্যমে ২০১৬ সালে কার্যকর করা হয়। এটি বাস্তবায়িত হলে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ইতিবাচক সমাধান চূড়ান্তভাবে সফল করা যাবে বলে আমি আশাবাদি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, শিল্প কারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও বনায়ন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।বন্যা নিয়ন্ত্রণ, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়নে যথোপযুক্ত বিনিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।সর্বশেষে প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পণ্যগুলোকে ব্যাবহারে উৎসাহিত করে এটির উৎপাদন বৃদ্ধি ও মূল্যমান সকলের নিকট সহজলভ্য করার যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণে সরকার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে ।
বাংলাদেশ বুলেটিনঃ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ইফতেখার মাহমুদঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।