কমলকুমার ঘোষ৷
ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক, গবেষক ও সাহিত্যিক।
মার্চ মাস । রাত তখন প্রায় ১২টা । গোটা কলকাতা শহরের চোখে ক্রমশ ঘুম নেমে আসছে । কিন্তু বৌবাজারে মধ্যরাতের তারারা তখনও নিদ্রাহীন । দামি ঝারবাতির নীচে ঘুঙুরুর তালে তালে তাদের কণ্ঠে ঝরে পরছে নানা সঙ্গিতলহরী । সুরা ও আতরের খুশবুতে তখন প্রতিটি মেহফিল জমজমাট । কোনও বাড়ি থেকে ভেসে আসছে ‘ঝুমকা গিরা রে , বৈরলি কি বাজার মে ঝুমকা গিরা রে’ । তার পাশেই শোনা যাচ্ছে, ‘দিলকে আরমান আঁসুয়ো মে বহে গ্যয়ে’ । তারই উল্টোদিকে আবার, ‘চলো দিলদার চলো, চাঁদকে পার চলো, হাম হ্যায় তৈয়ার চলো’ । ভাল করে কান পাতলে মনে হবে যেন গানের ককটেল । সেইসব বাড়ির নীচে রেস্তোঁরাগুলো তখনও খোলা । চারিদিকে বিরিয়ানির গন্ধ ম ম করছে । দুজন বিহারী, একজনের ঠ্যালা, অন্যজনের টানা রিক্সা, ‘বাংলা’র প্রভাবে তাদের মধ্যে রাস্তার উপারেই বচসা শুরু হয়েছে । দুজনের মুখ থেকেই রাষ্ট্রভাষার খিস্তিখেউড় ছুটছে ছররার মতো । এরই মধ্যে রাজাবাজার থেকে বিবাদী বাগের শেষ ট্রামটা টুং টুং করতে করতে দুলকি চালে তাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল । কিন্তু সেটা লালবাজার পৌঁছানোর আগেই শোনা গেল এক বিকট শব্দ । পরপর দুবার । যেন মনে হবে কোনও বিদেশী শক্তি বোমা ফেলছে । সেই শব্দ ইথার তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল তিন কিলোমিটার দূর পর্যন্ত । কিন্তু শব্দটা কীসের ? সেই আওয়াজে ততক্ষণে ব্রিটিশ আমলের লালবাজারও থরথর করে কেঁপে উঠেছে । যেসব পুলিশ ভাবছিলেন, শহর আজ শান্ত, এই গরমে এসি চালিয়ে রাতটা বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমনো যাবে, তাঁদের টনক নড়ে গেছে । অয়্যারলেসে আশেপাশের প্রত্যেকটি থানাকে তাঁরা জিজ্ঞেস করছেন, – ওসি কন্ট্রোল বলছি, আপনার এলাকায় কোনও ব্লাস্ট হয়েছে ?- আমরাও শুনেছি স্যার । কিন্তু এখনও কোনও খবর পাইনি স্যার । মেজবাবু বেরিয়েছেন । বড়বাবু কোয়ার্টার থেকে আসছেন স্যার । পেলেই জানাচ্ছি স্যার ।
শেষে আসল খবরটা দিল বউবাজার থানা । সেদিন রাতে ডিউটিতে ছিলেন সাব ইন্সপেক্টর এস কে চ্যাটার্জী । পুরো নাম শ্যামলকুমার চ্যাটার্জী । তিনি রাউন্ড – এ বেরোনোর তোরজোড় করছিলেন । এমন সময়ে ঘটনাটি ঘটে । তিনি কয়েকজন কনস্টেবলকে নিয়ে জিপে উঠতে যাবেন , হটাৎ থানার ফোনটা বেজে ওঠে । কান্নামিশ্রিত গলায় কেউ একজন আর্তি জানাচ্ছেন, ‘হামলোগোঁ কো বচাইয়ে সাব । করিম ভাইয়াকা মকানমে বিস্ফোট হুয়া । বড়া আগ লাগ গিয়া । দো মকান ধীরে ধীরে গির পড়তা হ্যায় । ম্যায় ভি উধার থা । লেকিন হাম নিকাল আনে কা বাদ হি হুয়া । আল্লাকা মেহেরবানীসে বঁচ গ্যায়া । আভি মেরা বগলবালা লকড়ি কা দুকান মে আগ লাগনেওয়ালা হ্যায় । জলদি আইয়ে সাব । কুছ তো কিজিয়ে ।‘
সাত বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শ্যামল চ্যাটার্জী আগে ছিলেন তিলজলা থানায় । সমাজবিরোধী তিনি অনেক ঘেঁটেছেন । তাই, ঘটনাক্রম বুঝতে তাঁর বিন্দুমাত্র দেরি হল না । এক লাফে জিপে উঠে ড্রাইভারের পাশে বসেই বললেন, ‘বউবাজার চল । করিম খান ।‘
ওদিকে, ততক্ষণে লালবাজারেও নানা জায়গা থেকে ফোন আসতে শুরু করেছে । দুঁদে পুলিশ অফিসাররা বুঝে গেছেন, বউবাজারে একটা বড় বিস্ফোরণ ঘটেছে । কিছুটা সেন্ট্রাল ফোর্স সেদিকে পাঠানো হয়ছে । খবর গেছে দমকলে । একে একে ইঞ্জিন এসে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে । অন্যদিকে , খবরের কাগজগুলোর অফিসে তখন সবার মাথায় হাত । ‘শেষ খবর’ বহু আগে লেখা হয়ে গেছে । বেশিরভাগ রিপোর্টার , ফটোগ্রাফার বাড়ির পথে । পেজ ওয়ানের প্লেট তৈরি হচ্ছে । এমনকি, প্রেস ক্লাবে যারা ছিল, তারাও আর নেই । দু’একজন নাইট রিপোর্টার, একজন ফটোগ্রাফার রাতের খাবার খেয়ে হাফপ্যান্ট বা লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে নিউজ টেবিলগুলো জুড়ে শোওয়ার ব্যবস্থা করছে । হটাত ফাঁকা ঘরে ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন ।- দাদা , বউবাজারে বাঈজিদের বাড়িতে বোম পড়েছে । তাড়াতাড়ি আসুন ।
ফোনটা ছাড়তে না ছাড়তেই চিফ রিপোর্টারের ফোন, ‘কি রে । ঘুমোচ্ছিস নাকি ? করিমের বাড়িতে ব্লাস্ট হয়েছে । তাড়াতাড়ি দৌড়ো । বউবাজার’ ।
বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী ষ্ট্রীটে করিম খানের নিজের বাড়ি । নাম ‘খুশবু মঞ্জিল’ । সেখানে দোতলায় তখন সারাদিনের সাট্টা ব্যবসার হিসেবনিকেশ চলছিল । করিম ছারাও সেখানে ছিল নাহিদ হোসেন ,ইমরান খান , রাজু জয়সওয়াল ও ইকবাল । ভয়ঙ্কর আওয়াজটা হতেই দৌড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসে ইকবাল দেখে, মেইন রোডের ওপারে করিম খানের অন্য দুতি বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলছে । খসে খসে পড়ছে বাড়ির এক একটি অংশ , তড়িৎগতিতে ঘরে ঢুকেই সে বলল, ‘ উস্তাদ, উস মকান মে বিস্ফোট হুয়া । আগ লাগ গিয়া । চলো , ভাগো’
প্রচণ্ড রেগে করিম চিৎকার করে বলে উঠল , ‘কৌন রেন্ডিকা ওউলাদ ইয়ে কাম কিয়া ? উধার লাখোঁ রুপিয়াকা মশল্লা জমা থা ।‘
ইকবাল বলল, ‘ঠিক হ্যায় । আভি ভাগো । পুলিশ আ জায়গা ।‘ ঠিক সেই সময় দরজায় এসে দাঁড়ালেন পঞ্চাশোর্ধব এক সুন্দরী মহিলা, নাম রেশমা আখতার । যিনি ছোটবেলা থেকে করিমকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন । করিম যাঁকে দিদি বলে ডাকে । তাঁর পাশেই তখন উঁকি দিচ্ছে একটি সুন্দর ফুটফুটে কিশোরীর মুখ । সে করিমের অষ্টাদশী কন্যা তমন্না । রেশমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ হ্যামলোগ ক্যা করে ভাইয়া ?’
করিম বলল , ‘হামারা সাথ চলো ।‘
দ্রুত গতিতে সবাই খুশবু মঞ্জিল – এর পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে পাশের সরু গলি ধরে ক্রমশ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল । তারপর দু-একটা কুকুরের ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না ।
বউবাজার থানার জিপটা সশব্দে ব্রেক কষে করিমের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল । সাব ইন্সপেক্টর কে চ্যাটার্জী অবাক হয়ে দেখলেন, বাড়িটা অক্ষত । বরং উল্টোদিকে দুটো বাড়ি জ্বলছে । ভেঙে পড়ছে । চারিদিকে চেঁচামেচি, হইচই, আর্ত চিৎকার । ছুটে গেলেন সেখানে । অয়্যারলেসে থানা থেকে ফোর্স পাঠাতে বললেন । এলাকার ছেলেরা অবশ্য তার আগে থেকেই উদ্ধার কাজে নেমে পড়েছে । ইতিমধ্যে এসে গেছে স্পেশাল টাস্ক ফোর্স অ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট-এর লোকজন । দমকলের তিনটি ইঞ্জিন । প্রানপনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে । আসছে আরও গাড়ি । গোটা মধ্য কলকাতায় তখন এক যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি । চারিদিকে শুধু দমকলের ঘণ্টা আর পুলিশের জিপ ও অ্যাম্বুলেন্সের হুটারের শব্দ । শুধু বউবাজার থানা নয়,
আশপাশের আন্যান্য থানা থেকেও ছুটে এলেন অফিসাররা । এল প্রচুর ফোর্স । কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়লেন পুলিশ কমিশনার অশোক তালুকদার । গোয়েন্দাপ্রধান ব্রজমোহন চক্রবর্তী এবং ডিসি(২) অজিত পুরকায়স্থ । এলেন অন্যান্য ডেপুটি কমিশনার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনাররা । এরই মধ্যে একফাঁকে তরুন পুলিশ অফিসার এস কে চ্যাটার্জী একজন এ এস আই এবং একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলেন করিম খানের বাড়িতে । সামনের দরজাটা বন্ধ । দ্রুত পাশের গলি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, পিছনের দরজাটা হাট করে খোলা । দুড়দাড় করে উঠে গেলেন উপরে । করিমের ড্রইংরুমে । যা ভেবেছিলেন, ঠিক তাই । পাখি উড়ে গেছে । অবিন্যস্ত ঘর । চারিদিকে সাট্টার প্যাড, স্লিপ, কিছু টাকাপয়সা ছরিয়ে-ছিটিয়ে আছে । এই ঘরটা শ্যামলের খুব চেনা । এর আগে বড়বাবুর নির্দেশে দু-চারবার আসতে হয়েছে । ছোটো-বড় প্যাকেটও নিয়ে গেছেন । করিম কিন্তু কোনওবার অতিথি আপ্যায়ন না করে ছাড়েনি । সে চা-ই হোক বা খুশবুদার সিরাপ । সঙ্গে কাজু, আখরোট তো থাকতই । একবার ঈদের সময় ‘দাওয়াত’ ও দিয়েছিল । কিন্তু কাজের চাপে শ্যামল আসতে পারেননি । যাই হোক, ঘরের চারিদিকে একবার পুলিশি দৃষ্টি চালিয়ে তিনি অন্যান্য ঘরগুলোতেও ঢুঁ মারলেন । কোথাও কিছুই পেলেন না । শুধু সিঁড়ির কাছে দেখলেন, জরির কাজ করা একপাটি লেডিজ স্লিপার পড়ে আছে । অন্যটি নেই । যেন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কারোর পা থেকে খুলে গেছে । তিনি সেটা তুলে ‘সিজার লিস্ট’ এ লিখে রাখলেন ।
ওদিকে , দমকলের দশটা ইঞ্জিন ততক্ষণে আগুন নিভিয়ে ফেলেছে । কিন্তু একের পর এক বেরিয়ে আসছে বডি । তাঁর মধ্যে কোনটা জীবিত আর কোনটা মৃত, বোঝাই দায় । সবাইকে পাঠানো হচ্ছে হাসপাতাল । সেখান থেকেও এস কে চ্যাটার্জী টুকটাক কয়েকটা নমুনা সংগ্রহ করে ফিরে গেলেন থানায় । তখন প্রায় ভোর। বৌবাজারে করিম খানের দুটিরেস্তোরার মধ্যে একটি ছিল সেন্ট্রাল এভিনিউ ও বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটেরমোড়ে । আর একটি বিধ্বস্ত দুটি বাড়ির মধ্যে প্রথমটির একতলায় ।ফুটপাত লাগোয়া । দুটোরই নাম ‘দিল্লি দরবার’ । দ্বিতীয় রেস্তোরাটিরকর্মচারীরা এবং কয়েকজন খদ্দের এ বাড়ির নিচে চাপা পড়েছে। তাদেরউদ্ধারের চেষ্টা চলছে। হঠাৎ সেখান থেকে একজনের দেহ বেরোতেই লুঙ্গিপরা একটা ছেলে বলে উঠল “আরে ইয়ে তো আশরফ ভাইয়া । হোটলেখানা পাকাতো। বহত আচ্ছা আদমি থা”।
সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের পুলিশ জানাল, এই দুটো বাড়িতেকয়েকজন বাঈজি ছাড়াও হিন্দু , মুসলমান নানা ধর্মের লোক থাকত ।কয়েকটা ঘর গোডাউন হিসেবেও ব্যবহার করা হত। অফিসও ছিল।প্রাথমিকভাবে যা বোঝা যাচ্ছে, তেমনই কোনও একটা ঘরে প্রচুরউন্নতমানের বোমা তৈরির মশলা মজুত করা ছিল। তাতেই বিস্ফোরণঘটে এবং আগুন লাগে । পরে, ফরেনসিক পরীক্ষায় আসল তথ্য জানাযাবে। হ্যাঁ, জানা গিয়েছিল, কেউ একজন ঠোটে জলন্ত বিড়ি নিয়ে এঘরে ঢুকেছিল। তাতেই বিপত্তি ।ওদিকে, ততক্ষনে বৌবাজার থানায় বসেসাব ইন্সপেক্টর এস কে চ্যাটাজী এফ আই আর লিখে ফেলেছেন । মূলঅভিযুক্ত করিম খান। পরে সেই রিপেটি অনুসারে মামলা দায়ের হয়ভারতীয় দর্ভবিধির ১২০ বি, ৪৩৬ , ৩২৬ ও ৩০৭ ধারায় ।
পরেরদিন সকালে জানা গেল, ৬৯ জন মারা গেছেন । আহত ৪৬ ।যাঁদের মধ্যে আশঙ্বাজনক অবস্থায় রয়েছেন বহু । যুদ্ধকালীনতৎপরতায় গুরু হয়ে গেল তদন্ত । অর্ন্ততদন্ত । স্থানীয় থানাগুলো ছাড়াওঝাঁপিয়ে পড়ল গো়য়েন্দা বিভাগ । নেতৃত্ব দিলেন ব্রজমোহন চক্রবর্তীনিজে ।কিন্তু করিম খানের বসতবাড়ি খানাতল্লাশি করতে গিয়ে বেরিয়েএল কেঁচোর বদলে কেউটে । পাওয়া গেল এক গুরুত্বপূর্ণ ডায়েরি । যাতেকরিম লিখে রাখত সবার নাম ধাম এবং লেনদেনের যাবতীয় হিসেবসেখান থেকে উঠে এল তৎকালীন স্থানীয় কাউন্সিলার আশিস দাস, স্বনামধন্য এম এল এ বঙ্কিম দে, বর্ষীওমান সাংবাদিক সুনীল ভট্টাচার্যএবং আরও কয়েকজনের নাম। শুধু তাই নয়, জানা গেল, মুখ্যমন্ত্রীরবাড়িতেও নিয়মিত খাবার যেত, ‘দিল্লী দরবার’ থেকে ॥ কবে কবে কী কীপাঠানো হয়েছে, বিরিয়ানি, চাঁপ, কাবাব, রোল, তন্দুরী তারও একটাপয়সা না পাওয়ার হিসেব কষা আছে । সেটা দেখে পুলিশ কমিশনারঅশোক তালুকদার বললেন, ‘পাতাগুলো ছিড়ে ফেল’।
এই ঘটনার ঠিক চারদিন আগে বম্বেতে এক বীভৎস বিক্ফোরণঘটেছিল। একটি নয় পরপর বারোটি । শহরের বিভিন্ন জায়গায় । যারফলে, ২৫৭ জন মারা গিয়েছিলেন । গুরুতর আহত হয়েছিলেন ৭১৩জন । সেটিও ঘটেছিল রাত দেড়টা থেকে পৌনে চারটের মধ্যে । সেক্ষেত্রেমূল অভিযোগ ছিল খালিদ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে ।
কলকাতার ঘটনাকে পুলিশ প্রথমে খালিদের চক্রান্ত হিসেবে সন্দেহকরেছিল | কারণ –
১) বম্বের ঘটনার ঠিক চারদিন পরে বৌবাজারের ঘটনাটা ঘটে ।
২) কলকাতায় করিম খানের সাট্টা ব্যবসাটা ছিল কে – কোম্পানিরফ্রারাঞ্চাইজি |
পরে পুলিশ বুঝল, তা নয় । বম্বেতে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করাহয়েছিল অত্যন্ত শক্তিশালী আর ডি এক্স । আর কলকাতারবিস্ফোরণটা হয় নিছক বোমা তৈরির মশলা থেকে, যা পরিমাণে ছিলপ্রচুর । তাই , এটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু করিম খানগেল কোথায় ? একটা জলজ্যান্ত মানুষ তো আর রাতারাতি উবে যেতেপারে না ক্রমশ পুলিশ জানতে পারল, করিম একা নয় । বৌবাজারবিস্ফোরণের সঙ্গে যুক্ত আছে তার আরও কয়েকজন সাকরেদ । নাহিদহোসেন, ইমরান খান, ফৈয়াজ খান, রাজু জয়সওয়াল ও ইকবাল । শুরুহল চিরুনি তল্লাশি। কলকাতা ও আশপাশে এবং অন্যান্য জেলায়।খবর গেল বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে । সিল করে দেওয়া হলসীমান্ত । গোপনে করিম যোগাযোগ করতে লাগল প্রভাবশালীরাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে । এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দূত পাঠাতেকসুর করল না । কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তাকে পুলিশের জালে ধরা পড়তেইহল। কলকাতায় তার এক আত্মীয়র বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ ।কয়েকদিনের মধ্যে এদিক-ওদিক থেকে ধরা পড়ল অন্যান্যরা । শুধুইকবালকে ধরতে পুলিশ দৌড়ল দিলি । তারপর, লালবাজারের সেন্ট্রাললক্ আপ থেকে আদালত হয়ে তাদের পাঠানো হল আলিপুর কেন্দ্রীয়সংশোধনাগারে।
ওদিকে, এই ক’দিনের মধ্যে বৌবাজার কাণ্ড নিযে রাজ্য রাজনীতিতোলপাড় হয়েছে। শাসকদলকে তুলোধনা করছে বিরোধীরা । মিটিং ,মিছিল কিছুই বাদ যায়নি । আঁচ গিয়ে পৌছেছে পার্লামেন্টেও। রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে । করিমখানের ডায়েরিতে যেসব রাজনৈতিক নেতার নাম ছিল, তাঁদের নিয়ে দলের রাজ্য অফিসেও নানা কান্ড ঘটে গেছে । ওপরতলা থেকেনিচেরতলা পর্যন্ত তোলপাড় । বারবার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছেনশীর্ষনেতারা । তাঁদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয়েছে । উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রীনিজেও । তিনি তাঁর আপ্তসহায়ক রাধেশ্যাম ঘোষকে দিয়ে পুরপিতাআশিস দাস ও দলের গুরুত্বপূর্ণ বিধায়ক বষ্কিম দে-কে রাজ্য দপ্তরে ডেকেপাঠিয়েছেন । সেখানে এক বিশেষ সভায় অন্যান্য নেতাদের সামনেজানতে চাওয়া হয়েছে নানা তথ্য । কেন তাঁদের নাম করিম খানেরগোপন ডায়েরিতে পাওয়া গেল ? তার সঙ্গে কতদুর গভীর সম্পর্ক ছিল? সাট্টা মাফিয়ার সঙ্গে টাকা পয়সার কোনও লেনদেন ছিল কি? শুধু তাইনয়, এব্যাপারে লালবাজার কতদূর কী জানে ? তার উত্তর দিতেবারবার ছুটে আসতে হয়েছে নগরপাল অশোক তালুকদার ও গোয়েন্দাপ্রধান ব্রজমোহন চক্রবর্তীকে । করিম খানকে এব্যাপারে জেলের মধ্যেজেরাও করা হয়। শেষে, আশিস দাসকে দল থেকে বহিস্কার করতে বাধ্যহয় দল । এবং বঙ্কিম দে কে চরম ভর্তসনা করে বলা হয়, ভবিষ্যতে তিনিযেন সতর্ক থাকেন। এইসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল কারণ শুধুই জনমানসেদলের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখা নয় এই দলের সংবিধান বড় কঠোর।
এখন প্রশ্ন হল, কে এই করিম খান ? তার পারিবারিক পশ্চাৎপটকী ? তারা কি আগাগোড়া কলকাতা বা পশ্চিমবাংলার বাসিন্দা ?নাকি ? অন্য কোনও প্রদেশ থেকে এসেছিল ভাগ্য খুঁজতে ? এসবপ্রশ্নের উত্তর হল – ১) করিমরা অবাঙালি মুসলিম । ২) তার বাবা মাঅত্যন্ত গরিব | এসেছিলেন বিহার থেকে। হ্যাঁ, অবশ্যই ভাগাম্বেষণে ।বাবা একটা হোটেলে বাসন পত্র মাজতেন । স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়েথাকতেন ফুটপাথের ঝুপড়িতে | ৩) অর্থাৎ করিমের পরিচয়, নিছক একপথশিশু ছাড়া আর কিছুই নয়।
বৌবাজারে এই ফুটপাথের কাছাকাছি থাকতেন এক অসাধারনসুন্দরী মহিলা রেশমা আখতার। যিনি আসলে ছিলেন চম্বলের প্রথমমহিলা ডাকাত পুতলিবাঈ এর মেয়ে। যৌবনে পা দিতে না দিতেইরেশমার বিয়ে হয়ে যায় উত্তরপ্রদেশের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে । কিন্তুতাঁদের কোনও সন্তান ছিল না।
করিম যখন ফুটপাথে আর পাঁচটা ছেলের সঙ্গে গুলি খেলত, তখনরেশমা কয়েকদিন যাতায়াতের পথে তাকে লক্ষ্য করেন | ছেলেটা রোগা, আর পাঁচজনের থেকে একটু লম্বা | গায়ের রঙ কালো হলেও, মুখেএকটা মিষ্টত্ব আছে। দেখতে দেখতে করিমকে রেশমার ভাল লেগে যায়।তার মধ্যে একটা সন্তানস্নেহ জেগে ওঠে । তিনি করিমকে নিজেরবাড়িতে নিয়ে এসে মানুষ করতে থাকেন। একটা মাদ্রাসা স্কুলে ভর্তিওকরে দেন। করিম তাকে “দিদি’ বলে ডাকে ।
এইভাবেই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে করিম। এরই মাঝে দীর্ঘরোগভোগের পরে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান তার মা ফতিমা বিবি।বাবা সাব্বির খান ছোট ছেলেকে নিয়ে আবার বিহারে ফিরে যান।মাদ্রাসায় পড়ার সময় করিমের সঙ্গে যাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল, তাদের মধ্যেবেশিরভাগই মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয়। এবং পরবর্তীকালেসমাজবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে পড়ে। করিম অবশ্য প্রথমদিকেরেশমার শাসনে সেই পথে যেতে সাহস পায়নি। কিন্ত ক্রমশ সেদাদাগিরিতে নেমে পড়ে । ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে একটা ‘বশীকরণ’ ক্ষমতা ছিল। সেই জোরেই দিনদিন সে সবার ‘উস্তাদ’ হয়ে ওঠে। শুরু হয়ছোটখাটো তোলাবাজি। সেটা রাজনৈতিক দলের নেতাদের নজরেআসে। তারা করিমকে নিজেদের দলে টানতে চেষ্টা করে। প্রথমে কংগ্রেস। পরে সিপি এম। শেষে জিতে যায় বামেরাই। করিমের পা যে দিনদিনস্খলিত হচ্ছে, অভিজ্ঞ রেশমা সেটা উপলব্ধি করতে পারেন। নানাদিকেখোঁজ নিয়ে তিনি বোঝেন, তাঁর সন্দেহ অমূলক নয়। তাই, করিমেরপায়ে বেড়ি পরানোর জন্য অচিরে তার একটা বিয়ে দেওয়া দরকার ।কিন্তু, বেকার ছেলেকে ‘নিকাহ’ করবে কে? কোন আব্বুই বা তার হাতেমেয়েকে তুলে দেবেন ? অতঃপর, অনেক ভেবে রেশমা আখতার ঠিককরলেন, করিমকে ব্যবসায় নামাতে হবে । কিন্ত কী ব্যবসা ? ছোটখাটোদিয়েই শুরু করা যাক। তাই, পাড়াতেই রাস্তার ওপর একটা দোকান দেখেমোগলাই রেস্তোঁরা খুলে দিলেন। নিজেই নাম রাখলেন ‘দিরি দরবার’ ।
উদ্বোধনের দিন সে এক এলাহি কান্ড । দোকান সাজানো হলপারিপাটি করে। সকাল থেকেই ব্যান্ড আর তাসা পার্টির আয়োজন ।ব্যাগপাইপার বাহিত চটুল হিন্দি গানের সুরে বিদীর্ণ হল বি বি গাঙ্গুলীস্ট্রিট । তার সঙ্গে গোলাপ জল আর আতরের খুশবু খদ্দের থেকেপথচারী, কাউকেই বঞ্চিত করল না। ফুটপাথ জুড়ে তৈরী হল প্যান্ডেল ।চোখ ধাঁধানো আলোর মায়াজালে সেখানেই সন্ধায় বসল কাওয়ালিরআসর । চঞ্চল কাওয়াল ও তাঁর দলবল সুরের মূর্চ্ছনায় জমিয়ে দিলেনমেহফিল। এই বিশেষ দিনটিতে রেশমা নিজের সন্তানসম করিমকেনতুনরূপে সাজিয়ে তুলবেন ভেবেছিলেন। তাই, ধর্মতলায় টিপু সুলতানমসজিদের পাশে বিখ্যাত দর্জি নৌশাদ আলির দোকান থেকে বানালেনএক ঝলমলে শেরোয়ানি আর চোস্ত পাজামা । এই পোশাকের সঙ্গেমাথায় মখমলের টুপি আর পায়ে চুমকি বসানো নাগরা পরে সেই সন্ধায়করিমকে মনে হচ্ছিন, যেন হিন্দি সিনেমার কোনও নায়ক । এখনই ঘোড়াছুটিয়ে কোনও মীনাকুমারী বা রেখাকে শাদি করে নিয়ে আসবে । তাকেদেখে রেশমা হেসে বললেন, ‘আজ তেরে কো নওসা (নতুন বর) য্যায়সালাগতা হ্যায় ভইয়া। জলদ্ সে তেরা শাদি হোনা চাহিয়ে’ ৷
করিম কানে হাত দিয়ে বলল, ‘তোবা তোবা। আভি ইয়ে সব মতসোচো দিদি। যো হোগা বাদ মে দিখা যায়গা’।
রেশমা বললেন, ‘নহি বেটা । আভি তুম ধীরে ধীরে উড়নে লাগে হো।তেরে কো পিঞ্জরে মে বন্ধ করনে কে লিয়ে মেরা এক বহু চাহিয়ে।‘
তাড়াভাড়ি প্রসঙ্গটা পাল্টানোর জন্য করিম বলে উঠল, ‘ঠিক হ্যায়। অভিদুকান মে চলো। মেহমান আনেওয়ালা হ্যায়।‘
সেদিনের অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথিদের মধ্যে স্থানীয় কাউ্ন্সিলরআশিস দাস, অন্য কেন্দ্রের বিধায়ক বঙ্কিম দে ছাড়াও অনেকরাজনৈতিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। সেই রাতে সব অনুষ্ঠান শেষ হয়েযাওয়ার পরে বাড়ি ফিরে করিম আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি।নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল। নিজের বাবা, মা আর ছোট ভাইটার জন্য তখন তার মনটা ছিঁড়েখুঁড়ে রক্তাক্ত।বারবার সেইসব মানুষগুলোর অভাব তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সেকিছুতেই ভুলতে পারছিল না যে, ভার ছোটবেলায় একদিন তার বাবাএমনই এক রেস্তোঁরায় বাসনপত্র মাজতেন।
এরপর, অত্যন্ত অল্পদিনের মধ্যেই মধ্য কলকাতার ‘দিল্লী দরবার’ যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । বিশেষত খাবারের গুণমানের জন্য। ক্রমশসেই নামডাক ছড়িয়ে পড়ে গোটা কলকাতা জুড়ে । এমনকি শহরেরআশেপাশেও ।
কিন্তু, রেশমা আখতার তীর প্রিয় ‘ভাইজান’ – কে যতই সোজা পথে নিয়েযাওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, অন্ধকার জগতের আহ্বান করিম কিছুতেইউপেক্ষা করতে পারে না।
রেশমা একদিন তার মা চম্বলের বেহোড়ের ডাকাতরানী পুতলিবাঈ-এর জীবনের কথা বলে করিমকে অনেক বোঝালেন। বললেন, অন্ধকার জগতে ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ । একথা বলতেও দ্বিধা করলেন না যে, ঐ জগতে জন্মের ফলে তিনি নিজেও জানেন না, তাঁর বাবা কে?
কিন্তু কথায় আছে না, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। করিম খানেরওতখন সেই অবস্থা ফলে, আবার শুরু হল তোলাবাজি। এবার ভারদোসর হল ছোটখাটো গুন্ডামি। এর পেছনে অবশ্য কিছুটা ইন্ধন ছিল।একদিকে, তার গজিয়ে ওঠা সাঙ্গোপাঙ্গোরা । যারা ভাবল, করিম ভাইয়াতো এখন ব্যবসা করে। কিন্ত তাদের রোজগারের কী হবে ? অতএব, জোরজুলুম, মারধর করে টাকা কামাও। তাছাড়া, বৌবাজার অঞ্চলে তোআর ব্যবসায়ীর অভাব নেই। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দল, বিশেষত বামনেতারা তাকে পরোক্ষভাবে কাজে লাগাতে শুরু করল।
আসলে, অন্ধকার জগতের পথটা মসৃণ না হলেও দিগন্তপ্রসারী। সেইদিকশুণ্য পথে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে করিম খান একদিন এসেপড়ে বন্দর এলাকায় । সেখানে তার সঙ্গে আলাপ হয় প্রতিষ্ঠিত সাট্টা ব্যবসায়ী ইয়াকুব খানের। ইয়াকুব ছিল ডাকসাইটে মার্কসবাদী নেতানিজামুদ্দিন শামস এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ । শুধু তাই নয়, ইয়াকুবেরব্যবসাটা ছিল ‘সাট্টা কিং’ খালিদ ইব্রাহিমের ফ্রাঞ্চাইজি। একদিন রাতেগঙ্গার ধার ঘেঁষা নিজের বিশাল বাড়িতে করিমকে দাওয়াত দিল ইয়াকুব। করিম কিন্তু একা গেল না। সঙ্গে নিল তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দুই দোস্তনাহিদ আর ইমরানকে | যাদের চেহারা দেখলে যে কোনও সাধারণমানুষের হাড় শুকিয়ে ষাবে। তারা অত্যন্ত সেয়ানা। তাই, পাঠান স্যুটেরনিচে, কোমরে ‘মেশিন’ গুঁজতে ভুলল না।তবে, সেদিন করিমদের জন্যএকটা বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। সে কথায় পরে আসছি।ইয়াকুব জানত, করিম একা আসবে না ! তাই, সেও তার দেহরক্ষী বিল্লুআর পাঙ্গাকে সঙ্গে রেখেছিল। সন্ধে নাগাদ করিমরা পৌঁছে দেখল, ইয়াকুবের বাড়ির দরজায় লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি পরা একটা রোগা লোকঅপেক্ষা করছে। জানল, তার নাম আলি। একটু খুঁড়িয়ে হাটতে হাটতেসে ‘মেহমান’ দের পৌছে দিল বস- এর অফিস সংলগ্ন আ্যান্টি চেম্বারে।ইয়াকুব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা জানাল। তারপরসবার জন্য আলিকে কেশর সরবৎ আনতে বলে শুরু করল আলোচনা। সে করিমকে বোঝাল, এই মুহুর্তে সবচেয়ে ভাল ব্যবসা হচ্ছে ‘সাট্টা’ । এতে লোকসান কম, লাভ বেশি ।‘হ্যাঁ’ ঝুঁকি একটু আছে বটে । কিন্তুরাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা থাকলে, কোন চিন্তা নেই। তাদেরসঙ্গে ‘সেটিং’ করে নিলেই হল। অতএব, করিম চাইলে উত্তর কলকাতায়এই ব্যবসাটা ফেঁদে বসতে পারে। ওখানে কেউ নেই। ইয়াকুব একথাওবলল, ‘হোটেল মে আপকো কিতনা ফায়দা হোতা হ্যায় ? ফিফটি ফিফটি। ইসমে তো হান্ড্রেড পারসেন্ট আয়গা ভাইয়া । ফির আপকা শিরপে বড়াভইয়া কা হাত ভি রহেগা’।
করিম বুঝল । একটু ভাবল । তারপর, দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে নিয়েইয়াকুবকে সায় দিল। মুহূর্তের মধ্যে টেবিলের বাঁদিকে রাখা সোনার জলকরা সুদৃশ্য ল্যান্ডফোনটা টেনে নিয়ে ইয়াকুব একটা কোড নম্বর ডায়ালকরল + ৯৭১৪… তারপর বাকি কয়েকটা সংখ্যা |
সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে উত্তর এল ‘আস্সালাম আলেকুম’।
আপকা নাম্বার’?
ইয়াকুব বলল , – ‘ওয়ালেকুম সালাম । সিপিওয়াই।’
করিমরা বুঝতে পারল, এই লাইনে সব সংকেতে কথা হয়। মাত্র কয়েকসেকেন্ডের মধ্যে ওপার থেকে উত্তর এল, ‘লেকিন, সাৰ তো আভি মিটিংমে হ্যায় । আপ জরা মেহেরবানি করকে থোড়া দের বাদ ফোন কিজিয়ে’ ।
ইয়াকুব বলল, ‘বড়া ভাইয়া কো বলিয়ে, ইয়ে আর্জেন্ট হ্যায়। বিজনেস কামামলা হ্যায়’ ।
টেলিফোন কণ্ঠ বলল, ‘হোল্ড কিজিয়ে’ ।
ইয়াকুব ফোন ধরে রইল।
মিনিটখানেক পরে ওপার থেকে আর একজনের কণ্ঠ ভেসে এল, ‘সালামআলেকুম । ম্যায় সুলেমান, বড়া ভাইয়াকা সেক্রেটারি। বোলিয়ে ক্যাবোলনা হ্যায়’ ।
ইয়াকুব বলল, ‘ওয়ালেকুম সালাম, সুলেমান ভাইয়া । আসল মে বাতইয়ে হায় কি, ইধার নর্থ ক্যালকাটা মে মেরা এক দোস্ত হ্যায়, করিম খান।থোড়া বহুত বিজনেস করতা হ্যায় । ফির, পলিটিক্যাল কানেকশনস্ ভিজ্যাদা হ্যায়। উনকো হাম লোগোঁকো কা সাথ জোড় লেনেসে, শায়দকাফি আচ্ছা হোগা। বড়া ভাইয়া চাহে তো উনকো দুবাই মে ভি লে সক্তা হুঁ।
সুলেমান বলল, ‘ঠিক হ্যায়। হাম ভাইয়াকো বতায়েঙ্গে । আপ কালদুবারা ফোন কিজিয়ে। ফির, (হেসে) আপ তো ভাইয়াকা খাস নজরদারিমে হ্যায়। তো সোচ লিজিয়ে, আপকা কাম ফিফটি পার্সেন্ট হো হি গ্যায়া’।
ইয়াকুব বলল, ‘বহুত বহুত সুকরিয়া’ ।
তারপর ফোনটা নামিয়ে রেখে করিমকে বলল, ‘চলিয়ে ভাইয়া হো গ্যায়া | আপকা মহল্লা মে আপ হি রাজ করেঙ্গে’।
করিম, নাহিদ ও ইমরানের মুখে তখন খুশির হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। সবাইইয়াকুবকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠতে যাবে, এমন সময় ইয়াকুব বলে উঠল, ‘লেকিন, আজ আ্যায়সা সুভদিন মে আপ য্যায়সা খাস মেহেমানোকোবিনা খানাপিনা ছোড় দেনেসে মেরা গুনাহ হোগা। আল্লা মুঝে মাফ নহিকরেগা । চলিয়ে, উপর মেরে গরিবখানেমে থোড়া তসরিফ রাখিয়ে’ ।
অতঃপর বাধ্য হয়ে করিমদের ইয়াকুবের কথা রাখতেই হুল। কিন্তু, তিনতলায় উঠে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাবার জোগাড় । গঙ্গার দিকেএকটা বড় ঘর। সেখানে আলোর রোশনাই। মাথার উপর দামিঝাড়বাতি। মাঝখানটা খালি রেখে চারিদিকে ফরাস পাতা । গোটা ঘরেআতর আর গোলাপের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। করিমদের জন্যে আলাদাবসার ব্যবস্থা। নরম গদির উপর মখমলের চাদর বিছানো। তার ওপরকয়েকটা লাল তাকিয়া। সামনে সুরাপাত্র , পানদান আতরদান ইত্যাদি।ইতিমধ্যে একজন উস্তাদ গোছের লোক সেখানে হারমোনিয়ামে সরগমকরছে। পাশে সারেঙ্গীবাদক ও তবলচিও হাজির। এই পরিবেশে পড়েততক্ষনে করিমরা একটু ঘাবড়ে গেছে। তবে, তাদের জন্যে আরও চমকবাকি ছিল। হঠাৎ ইয়াকুব বলে উঠল, ‘আরে মুস্তাক, মুন্নিবাঈকো বুলাও’৷
কয়েক মুহুর্তের মধ্যে সবার মনে হল, বেহেস্ত থেকে যেন কোনও অপ্সরাঝা নুর তাদের সামনে হাজির হয়েছে। ঘাঘরা-চোলি, পায়ে ঘুঙ্গরু, মাথায়রুপোর তাজ। পাকা গমের মত গায়ের রঙ, গোলাপি ঠোট, হরিণের মতচোখ। ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্ব, স্ফীত বক্ষ। যা প্রায় কাঁচুলি ভেদ করেবেরিয়ে আসতে চাইছে। বয়স ত্রিশ কি পয়ত্রিশ। করিম, নাহিদ ও ইমরানতখন যেন সম্মোহিত। মুন্নিবাঈ এসে ঘরের মাঝে ফাঁকা অংশটায়দাড়িয়ে প্রথমে নতশিরে সবাইকে কুর্নিশ করল। ইয়াকুব বলল, ‘ঔর দেরকিঁউ মুন্নিবাঈ। চলো মেরা মেহমানোকো তুমহারা চমৎকারি দিখাও।ইয়ে রাতকো নশিলা বনা দো’ । ঘাঘরাটা গোল করে ছড়িয়ে মেঝেতেবসল মুন্নিবাঈ। আর একবার সবাইকে কুর্ণিশ করল । বেজে উঠলযন্ত্রসঙ্গীত। শুরু হল গান। আগ্রাওয়ালী খাস বাঈজি মুন্নিবাঈ ধরল, ‘নয়নোবালি নে, হ্যায়, মেরা দিল লুটা…..’।
জানা গেল, মুন্নিবাঈকে আনা হয়েছে সোনাগাছির ‘নন্দরানী বিল্ডিং’ থেকে । করিম খান যত বিপথগামী হোক না কেন, দুটি দোষে সেকোনওদিনই দুষ্ট ছিল না।
১) মদ্যপান এবং ২) নারীসঙ্গ ।
তাই সেই রাতে ইয়াকুবের হাজার অনুরোধেও করিম ঠোটে একফোঁটাশরাব ছোঁয়ায়নি। কারণ, প্রতিদিন পাঁচ ‘ওয়াক্ত’ নমাজ আদায় করাধর্মপ্রাণ করিম মনে করত, কোরাণ ও হাদিস অনুসারে মদ খাওয়া চরমগুনাহ্ বা পাপ।
এরপর মাসখানেকের মধ্যেই কে-কোম্পানির ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি’ হিসেবে করিমখানের সাট্টা ব্যবসা শুরু হল। ক্রমশ তার জাল বিস্তৃত হতে লাগলগোটা উত্তর কলকাতা জুড়ে। বলা বাহুল্য আর্থিক দিক থেকে করিমদিনদিন ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল। একটা ‘স্করপিও’ হল। রেশমাআখতারের বাড়ির উপরে আরও দুটো তলা উঠল। এবং করিম খানেরকাছে রাজনৈতিক নেতা ও উপনেতাদের, বিশেষত বামেদের আনাগোনাবাড়তে শুরু করল।
এর বেশ কিছুদিন পরে করিম খান ঠিক করল, আর একটা রেস্তোঁরাখুলবে। কারণ, পুরনো দোকানে আর ভিড় সামলানো যাচ্ছে না। স্থানীয়পুরপিতা আশিস দাসের বদান্যতায় সেন্ট্রাল আ্যাভিনিউ ও বি বিগাঙ্গুলি স্ট্রিটের ঠিক মোড়ে একটা জুতসই ঘর পাওয়া গেল। সেটাকেসাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি হল নতুন মোগলাই বিপনি। সেটারও নাম রাখাহল প্রথমটির মতোই ‘দিল্লি দরবার’ | এবারও উদ্বোধনের দিন জাঁকজমককম হল না। ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছুর দেখভাল করলেন দিদিরেশমা আখতার নিজে । ওদিকে, ইয়াকুব খানের বাড়ির মজলিশ থেকেঘুরে আসার পর, করিম খানের মাথায় একটা পোকা প্রতিনিয়তকিলবিল করছে। এমনকি, ঘুমের মধ্যেও রেহাই দিচ্ছে না। আসলে সেইরাতের ঐ মায়াবী পরিবেশ এবং কিন্নরী মুন্নিবাঈ-এর নাচ ও গানকরিমকে যথেষ্ঠ আপ্লুত করেছিল। তারপর থেকেই সে ভাবতে থাকে, বাঈজিদের নিয়ে ব্যবসা করলে কেমন হয় ? করিম জানত, বৌবাজার-এরবাঈজি ঘরানা বহু পুরনো । সাহেবদের আমল থেকে চলে আসছে । কিন্তুএখন বাঈজিদের সেই কৌলিন্য আর নেই। সংখ্যাতেও তারা নগণ্য ।অন্যদিকে দ্বারকানাথ ঠাকুরের হাত ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিসোনাগাছির পত্তন করলেও পতিতাবৃত্তিই ছিল সেখানে মুখ্য । নাচ-গানগৌণ । আর এখন তো বেশিরভাগ বাড়িতেই যৌনকর্মীরা ক্যাসেটে হিন্দিফিলোর গান চালিয়ে খদ্দেরদের সামনে নগ্ননৃত্য করে । অথচ বাঙালিরবিবি-বিলাস এবং বাবু -সংস্কৃতি তো কলকাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে । অতএবসেটাকে যদি আর একবার উসকে দিয়ে আগ্রা বা লক্ষৌ থেকে জাত-বাঈজিদের নিয়ে আসা যায়, তাহলে বোধহয় ‘খুশবু মঞ্জিল’ -এ টাকাশুধু উড়বে আর উড়বে । একদিন রাতে করিম খাবার সময় রেশমাআখতারের সঙ্গে এই ভাবনাটা নিয়ে আলোচনা করল 1 রেশমা দু-তিনদিন সময় নিলেন। তারপর অনেক চিন্তা করে শেবে সায় দিলেন ।করিম বলল, ‘লেকিন দিদি, ইয়ে বিজনেস তুমকো হি সাম্হালনাপড়েগা । ম্যায় পিছে রহুঙ্গা’। ইতিমধ্যে করিমের সাট্টা ব্যবসা বেশ জমেউঠেছে। আশপাশের প্রত্যেকটা থানার সঙ্গে তার সেটিংটাও বেশমোলায়েম | সেই সুবাদে ‘খুশবু মঞ্জিল’, এর উল্টোদিকে দুজন ক্ষয়িষ্ণুবাঙালির দুটো বাড়ি ভাড়াটে সমেত কিনে নিয়েছে। যাকে বলা যায়, একেবারে জলের দরে । তারপর সেই ভাড়াটের কাউকে সামান্য কিছুপয়সা দিয়ে, আবার কাউকে শুধুই ধমকে-চমকে উৎখাত করছে । করিমঠিক করল, বাড়ি দুটো একটু সারিয়ে নিয়ে একটা অংশ মোটা টাকায়বিভিন্ন মানুষকে ভাড়া দেবে। বাকি অংশে করবে বাঈজি-বানিজ্য ৷
এরপর একদিন বন্দর মাফিয়া ইয়াকুব খানের কাছে গিয়ে করিম তারবিস্তারিত পরিকল্পনার কথা জানাল। ইয়াকুব বলল , সেও এই ব্যবসারশরিক হতে চায়। বাঈজি মহল্লায় তার যোগাযোগ দীর্ঘদিনের । কারণ, লক্ষৌতে সে জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে । এখনও তার বাপ -ঠাকুর্দা সেখানেইথাকেন । একসময় নাকি তাদের ছোটাখাটো একটা নবাবিও ছিল 1 করিম ইয়াকুবের এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল এককথায় । সে দেখল, ইয়াকুব তাকে সাট্টায় নামিয়েছে, তাই এর মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জানানোযাবে। তাছাড়া সে তো চাইছিল এই ব্যবসার পেছনে থাকতে । অতএবইয়াকুব আর রেশমা যদি সামনে থেকে ব্যবসাটা চালায়, তাহলে ভালইহবে।
করিম ও ইয়াকুব একদিন দুপুরে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতেমুন্নিবাঈ এর কাছে গেল। সে জানাল, নন্দরানী বিন্ডিং-এ দিনদিনঘাটিয়া কাস্টমার এর ভিড় বাড়ছে। তাই মুন্নি সেখানে থাকতেও চায় না।অতএব, বৌবাজার যেতে তার আপত্তি নেই । তাছাড়া ফতেপুর , আগ্রাথেকে সে খাস বাঈজিদেরও এনে দেবে। শুধু লক্ষৌটা করিমদেরসামলাতে হবে । ইয়াকুব বলল, ‘ঠিক হ্যায়’ ।
বঙ্কিম দে তখন বিধায়ক হননি । তবে, বাম দলের দাপুটে নেতা । সেইসময় বৌবাজার অঞ্চলটি ছিল কংগ্রেসের দখলে । কিন্তু , সেখানেবঙ্কিমবাবুর আধিপত্য কম ছিল না। করিম তখন বঙ্কিম ও কংগ্রেসনেতাকে একই সঙ্গে তোয়াজ করত । সব ব্যবসায়ীরা যেমন করে থাকে ।অতএব, এই সব নেতাদের হাত মাথায় নিয়ে করিম ও ইয়াকুব নির্ভয়েকাজ শুরু করে দিল। সেই নতুন কেনা বাড়ি দুটি সেজে উঠল | একেএকে আসতে লাগল অপরূপ সুন্দরী বাঈজীরা । এইভাবে বৌবাজারেআবার নতুন করে শুরু হল কলকাতার খাঁটি বাঈজি-বিলাস। যারকলকাঠি রইল রেশমা আখতারের হাতে ।
দিদি কিন্তু এবার সত্যিই একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন । কারন, ভাই যেভাবে পাখা মেলতে শুরু করেছে, তাতে তার ভবিষ্যৎ খুব একটা সুখেরনাও হতে পারে। অতএব, পায়ে বেড়ি পরানো দরকার শুরু হল সুন্দরীকন্যার অনুসন্ধান চারিদিকে খোঁজ করতে করতে শেষ পর্যন্ত পাওয়াওগেল। নেহারুন্নিসা। বছর কুড়ি বয়স। আহা, কী রূপ । যেন বেহেস্তেরগুলাব বাগ থেকে একটা ফুল খসে পড়েছে। এরপর একদিন ব্যান্ড, তাসাবাজিয়ে, নবাব সেজে, ঘোড়ায় চড়ে করিম খান গেল বিয়ে করতে। পার্কসার্কাসে। সেখানে কাজী ও মোল্লার উপস্থিতিতে ‘দেনমোহর’-এর পরিমাণঠিক করে , ‘কাবিলনামা’ পড়ে এবং অন্যান্য ধর্মীয় আচার-আচরণমেনে তার শাদি হল নেহারুন্নিসার সঙ্গে। শুরু হল করিমের সংসারজীবন। ক্রমে ঘরে এল সম্ভানাদি ।
আবার ফিরে আসি,বৌবাজার বিস্ফোরণ কান্ডে। ততদিনে এই ঘটনারাজ্য ও কেন্দ্রে হইচই ফেলে দিয়েছে। চলছে রাজনৈতিক চাপান-উতোর।চুলচেরা অনুসন্ধান শুরু করেছে ইন্টারপোল ও | মামলা চলে দীর্ঘদিনধরে। আজও যা শেষ হয়নি। আলিপুর কোর্ট থেকে হাইকোর্ট । সেখানথেকে সুপ্রিম কোর্টে । এইভাবে কেটে যায় প্রায় বছর দুয়েক। তারপর, এইগুরুত্বপূর্ণ মামলাটিকে (Terrorist and disruptive Activity(Prevention))-এর আওতায় এনে ‘টাডা’ আদালতে পাঠানোহবে কি না, তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা চিন্তাভাবনা শুরু করেন।করিমদের আইনজীবিরাও আপ্রান চেষ্টা করতে থাকেন, যাতে তা না হয়। কারন টাডা কোর্টে যাওয়া মানে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ।
অতঃপর এল সেই দিন । সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষনা করবে। সেখানথেকেই রেশমা আখতার, নেহারুন্নিসা ও করিমের ছেলেমেয়ে ‘খুশবুমঞ্জিল” -এ নামাজ পড়া শুরু করল। পাশাপাশি চলল আল্লাহর কাছেদোয়া চাওয়া এবং মসজিদে কোরাণ পাঠ । আইনজীবি অবশ্য আশ্বাসদিয়েছিলেন, ‘এই কেস হারগিস টাডা কোর্টে যাবে না’। সুগ্রিম কোর্টেইথাকবে৷ সেই আনন্দে পাড়ার ঘনিষ্ঠ কিছু লোক আগাম ব্যান্ড পার্টিরব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ফুল, মালার অর্ডার দেওয়া ছিল। উদ্দেশ্য, সন্ধ্যায় করিম খানের ছবি নিয়ে বিজয় মিছিল করা । কিন্তু বিধি বাম ।বিচারক ও আইনজীবি পারস্পারিক যুক্তি চালাচালির পরে সুপ্রিম কোর্টদিনের শেষে রায় দিল, বৌবাজার বিস্ফোরণ মামলা টাডা আদালতেইপাঠানো হবে। ‘খুশবু মঞ্জিল’ এ উঠল চাপা কান্নার রোল । পোশাকপাল্টে ফিরে গেল ব্যান্ড পার্টি। ফুল ও মালা অবহেলায় পড়ে রইলবৌবাজারের ফুটপাথে ।
এরপর করিম খান ও অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে টানা আইনের ৩ ও৪ ধারা অনুসারে মামলা রুজু হল। টানা ৬ বছর মামলা চলার পরে, টাডা আদালত করিম খানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে । বহু বছর পরে সেদিন করিমের চোখ আবার ভিজে উঠেছিল । আর একটাদীর্ঘশ্বাসের সঙ্গ মুখ বেরিয়ে এসেছিল, ‘হায় আল্লা ।’ ।
এর ফলে, করিমের সাট্টা ব্যবসা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। ক’জনবাঈজি বিস্ফোরণের পরে বেঁচে ছিল, তারাও যে যার ফিরে গেল। দু-একজনের সে উপায় ছিল না। তাই ভারা সোনাগাছিতে গিয়ে যৌনকর্মীরখাতায় নাম লেখাল। পড়ে রইল শুধু বৌবাজার মোড়ের ‘দিল্লী দরবার’।কিছুদিন পরে রেশমা আখতার সেই রেস্তোঁরাও বিক্রি করে দিলেন।
প্রথমদিকে , সংশোধনাগারে করিম খান জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেসহযোগিতার পরিবর্তে চরম দুর্ব্যবহার করত। সবসময় তার মধ্যে দেখাযেত প্রবল এক অস্থিরতা । ঠিক সেইসময় আই জি (কারা) হয়ে আসেনএক সংস্কৃতিপ্রবণ আইপি এস অফিসার দীনদয়াল শর্মা ওরফে ডি ডিশর্মা । তার আগে তিনি গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে এবং পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্নগুরুত্বপুর্ণ পদে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে পুলিশের দায়িত্ব সামলেছেন। তিনিএসে সংশোধনাগারে চালু করলেন ‘Cultural Therapy’ । অর্থাৎ নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, পুরুষ বা মহিলা যে কয়েদীর মধ্যেযে প্রতিভা লুকিয়ে আছে , তার বিকাশ ঘটানো। শুরুতে জেল কর্তৃপক্ষেরএতে সায় ছিল না। পরে ডি ডি শর্মা যুক্তি দিয়ে তাঁদের বোঝালেন যে, একজন দাগী আসামীরও চিত্ত পরিবর্তন ঘটতে পারে । তারপরই এইরাজ্যের বিভিন্ন সংশোধনাগারে শুরু হল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। এইভাবেইডি ডি শর্মার নজরে পড়ে করিম। তার ইচ্ছা অনুসারে আই জি তাকেঅঙ্কন শিক্ষার সুযোগ করে দেন। বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী বিশু দে হন তারশিক্ষাগুরু। করিমের মধ্যে এর পর থেকেই ধীরে ধীরে একটা পরিবর্তনআসতে শুরু করে। মনের অস্তিরতা প্রশমিত হয়। নিষ্ঠাবান ছাত্রের মতসে প্রতিদিন বিশু-দের কাছে আঁকা শেখে এবং নিজেও ছবি আঁকতে চেষ্টাকরে। শুধু তাই নয়, সংশোধনাগারের অন্যান্য আবাসিকদের সে বন্ধুহয়ে ওঠে । তাদের মানসিক পরিবর্তনের চেষ্টা করে | আজও যে ব্রতে সেঅবিচল।
করিম খান যখন প্রথম জেলে যায়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৯বছর। তার যাবজ্জীবন কারাদন্ড যখন হয়, তখন সে ৪৬। অর্থাৎততদিনে তার সাত বছর জেল খাটা হয়ে গেছে সাধারনত এই ধরনেরআসামীদের আচার ব্যবহার ভাল হলে চোদ্দ বছর পর সরকারেরঅনুমোদন সাপেক্ষে জেল কর্তৃপক্ষ তাদের মুক্তি দিতে পারে । সেই হিসেবঅনুযায়ী আরও ৭ বছর পরে করিম খান পশ্চিমবঙ্গে তৎকালীনমুখ্যমন্ত্রীর কাছে আইনজীবী মারফত মুক্তির আবেদন জানায় । কিন্তবেশ কিছুদিন চেষ্টাচরিত্র এবং আলাপ আলোচনা করেও তা ফলপ্রসু হয়না। কারণ, অন্যান্য অপরাধের থেকে এই অপরাধ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তাছাড়া , মামলাটি হয়েছিল টাডা আদালতে। তাই টাডা আইনঅনুসারে করিম খানকে মুক্তি দিতে হলে, গোটা দেশের আরও বহুআসামীকে ছেড়ে দিতে হয়। যা কার্যত সম্ভব নয় ।
তবে এই নিয়ে করিমের এখন আর কোনও তাপোত্তাপ নেই। সেমনে করে, একদিন অন্যায় করেছি, তাই ফল ভোগ করছি । সবই আল্লারকৃপা ।
সংশোধনাগার থেকে মুক্তি না পেলেও, করিম খান আজ এক মুক্তপুরুষ । ষড়রিপুর কোনওটাই আর এখন তার মধ্যে কাজ করে না । বরংআধ্যাত্মিকতাবোধ প্রবল হয়েছে । কেমন একটা শান্ত, সমাহিত ভাব।বেড়েছে কল্পনা শক্তি । আরও বেশি মন বসেছে ছবিতে । তাই প্রতিনিয়তকরিমের ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে গাছপালা, নদী, পাখী ও নানা প্রাকৃতিকদৃশ্য । একেই কি বলে চিত্তশুদ্ধি বা শুদ্ধিকরণ ?
* এই কাহিনীর প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক । এইসব চরিত্রের সঙ্গে কেউকোনওভাবে নিজের মিল খুঁজে পেলে, তা হবে নিতান্তই কাকতালীয় ।তার জন্য লেখক বা প্রকাশক দায়ী হবে না ।