সামছুল আলম সাদ্দামঃ
রাষ্ট্রের জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে রাজনৈতিক দলের স্বপ্নের সমন্বয় একটি রাষ্ট্রকে কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় পৌঁছাতে কোন প্রতিকূলতা কার্যকর হতে পারে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার প্রমাণ। এই উপমহাদেশে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাঙালির শোষিত হৃদস্পন্দনের রক্ত স্রোতে, আদর্শিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে। ক্ষমতাবান মানুষের ক্ষমতার বিস্তার ঘটানো বা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী কারার পরিকল্পনা থেকে নয়, বরং ক্ষমতার বিপক্ষে শোষিত মানুষের মুক্তির প্রয়োজনে গণমানুষের শক্তির সম্মিলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জন্ম। পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম আওয়ামী লীগ থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে উন্নীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে এই রাজনৈতিক সংগঠনটি বাঙালির স্বপ্ন পূরণের দুর্দান্ত ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্থান স্বাধীন হলে পূর্ব পাকিস্থানের বাঙালিদের জন্য এই স্বাধীনতা মুক্তির গল্প হওয়ার পরিবর্তে প্রহসনমূলক নাটকে পরিণত হয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা পরিণত হন নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ের প্রাসঙ্গিক রাজনীতিতে মাতৃভাষার জন্য সংগ্রামে, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা ছাড়াও সকল স্তরের মানুষের জন্য প্লাটফর্ম তৈরির অবদান আওয়ামী লীগের। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে সফলতা, বাঙালির মুক্তির মাস্টার প্লান ছয় দফা প্রদানসহ গণঅভ্যুত্থানের গণজোয়ার সৃষ্টি, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিকামী মানুষের হৃদস্পন্দনকে বাঙালির গর্জে ওঠার ইতিহাসে পরিণত করেছে অসাম্প্রদায়িক এই রাজনৈতিক দলটি। ১৯৭০ সাল পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে বাঙালি মুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
জাতীয় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ঘোষণায় বাঙালি জাতিকে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে তৈরি করেছিলো আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধকালীন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকলেও বঙ্গবন্ধুর পূর্ববর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একমাত্র অবদান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। মুক্তিযুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করে সেটি টিকিয়ে রেখে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে শৃঙ্খলে রাখা সম্ভব হয়েছিলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সুদৃঢ় সাংগাঠনিক কাঠামোর নেতৃত্বে।
স্বধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির পিতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন ও গণমানুষের জীবনমান উন্নয়ন করে ক্ষুধা- দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে পদক্ষেপ নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ যে অবদান রেখেছে পৃথীবির ইতিহাসে রাজনৈতিক দল হিসাবে এককভাবে দেশের জন্য এমন অবদান রাখার নজির নেই। গণমানুষের হৃদস্পন্দন অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে সময়ের সাথে সর্বস্তরের মানুষের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে এককভাবে এতটা অবদান রাখার পরও স্বাধীনতা অর্জনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা কুক্ষিগত না করে নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালির ভাগ্য যখন অনিশ্চয়তায় যাত্রা করেছিলো, সামরিক শাসনের বুটের তলায় যখন সমগ্র বাংলাদেশ তখনও স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিয়ে গণমানুষের মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগ কখনও এককভাবে কখনও রাজনৈতিক দলগুলোকে সমন্বয় করে সংগ্রাম চলমান রেখেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ১৫ ই আগস্টের খুনিদের বিচারের জন্য বাঙালির আকাঙ্ক্ষিত দাবি পূরণের জন্য আওয়ামী লীগ সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। কুখ্যাত রাজাকারদের ফাঁসি কার্যকর করে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলমান রাখা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করে রায় কার্যকর করতে সহায়তা ও এ সকল বিচার চলমান রাখতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখনও সোচ্চার।
বাঙালি হিসাবে একজন নাগরিক যদি জন্মগ্রহণের পর থেকে যদি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চেতনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বেড়ে ওঠে, তবে সে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে ধারণ করে। পরিপূর্ণ আদর্শিক বাঙালি বলতেই সেই মানুষটি আওয়ামী লীগের চেতনার। রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর ক্ষমতার দম্ভে নয় শ্রমিক থেকে বিত্তবান, কৃষক থেকে কর্মকর্তা, ধনী- দরিদ্র সকল শ্রেণির মানুষের শারিরীক থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক বিনিয়োগের ফল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সময়ের সাথে তাল মিলায়ে গণমানুষের হয়ে বহমান এই রাজনৈতিক সংগঠনটি সর্বশেষ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও উদার রাজনৈতিক মনোভাব নিয়েই বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বর্তমান সময়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিবেচনায় শক্তিশালী সাংগাঠনিক কাঠামোবিশিষ্ট জনসম্পৃক্ত ও সুপরিকল্পিত উন্নয়নমূখী রাজনৈতিক দল। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাকাশে স্যাটেলাইট থেকে সমুদ্র বিজয়ের ক্যারিশমা, ‘মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই’ শব্দের বিলুপ্তিকরণে বিভিন্ন স্তরে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন, মঙ্গা শব্দের বিলুপ্তি ঘটিয়ে উত্তরবঙ্গকে ক্ষুধামুক্ত করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরবর্তী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অধিক সক্ষমতা অর্জন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, ৫৬০টি মডেল মসজিদ স্থাপন করে ইসলাম ধর্মের যেকোন রাষ্ট্র প্রধানের চেয়ে একসাথে বেশি সংখ্যক মসজিদ গড়ার রেকর্ডসহ সমৃদ্ধ উন্নত ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংগঠনটির দুর্দান্ত অগ্রগতি চলমান রয়েছে।
সময়ের সাথে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলের কর্মদক্ষ কর্মী তৈরির সক্ষমতা অর্জনে একদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির কাজ করছে, অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকার ফলে রাজনৈতিক কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা রোধে দলের সাংগঠনিক নিয়মে কঠোরতা এনেছে। করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংঠনের নেতাকর্মীরা মানুষের পাশে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। অঙ্গসংঠনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, যুবলীগ মানুষের পাশে ত্রাণসহ সাহায্য করে যাচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবকলীগ স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে, কৃষকলীগ কৃষকদের ধান কাটা সহ সহযোগিতা করছে, সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগ মানুষের যেকোন চাহিদা পূরণে দেশে সর্বাত্মক সহযোগিতা চলমান রেখেছে।
বাঙালি জাতি হিসাবে যখন যে স্বপ্ন দেখেছে, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ জনগণকে সাথে নিয়েই নেতা কর্মীদের জীবনের বিনিময়ে হলেও সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে। একদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের হয়ে বর্হিবিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে কৌশলী, অন্যদিকে অনান্য দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও রাজনৈতিক দল হিসাবে নিজস্ব স্বকীয়তা ধরে রেখে উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসাবে ২০২১ সালের ২৩ জুন উদযাপন করছে ৭২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। তারুণ্য শক্তিকে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে কর্মদক্ষ করে বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অগ্রগতি চলমান রেখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলার গণমানুষের স্বপ্ন পূরণের সাহস হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাঙালির অবিভাবক হয়ে থাকবে, এমনটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।